রাজধানীর ইন্দ্রিরারোডে সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম সাইদুর আফতাবের। শৈশব ও কৈশোরের সোনালী দিনগুলি কাটে তার রাজধানীতেই। বাবা মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার আর মা গৃহিনী। তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তিনি চতুর্থ। আহসানুল্লা ইউনিভার্সিটি থেকে বিবিএ ও ইউনিভার্সিটি অব সাউথ এশিয়া থেকে এমবিএ পাস করেন তিনি।
আফতাব ছোটবেলায় স্বপ্ন দেখতেন দেশের জন্য ভালো কিছু করার। কিন্তু সে স্বপ্ন কেমন করে পূরণ হবে তা জানা ছিলো না তার। পরবর্তীতে প্রতিষ্ঠা করেছেন সিটিএফএম৯৬ (CITYFM 96.00) রেডিও স্টেশন। অল্প বয়সে একটা এফএম রেডিও স্টেশনের মালিক হওয়া বাংলাদেশের ইতিহাসে এটাই প্রথম। তিন বছরে সফলভাবে অনুষ্ঠান পরিচালনা করে দেশের ১২টা এফএম রেডিওর মধ্যে চতুর্থ স্থানে রয়েছে রেডিও স্টেশনটি।
বৃহস্পতিবার বিকেলে গিয়েছিলাম রাজধানীর বাংলামটর CITYFM 96.00 রেডিও স্টেশনের অফিসে। জীবনের নানা দিক নিয়ে অনেকক্ষণ কথা হয় রেডিও স্টেশনটির প্রতিষ্ঠাতা সাইদুর আফতাবের সাথে। একান্ত আলাপে সিটিএফএম রেডিও স্টেশনটির শুরু এবং বর্তমান হালচালের নানান কথা বলেন তিনি। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন বিবার্তা২৪.নেটের নিজস্ব প্রতিবেদক- উজ্জ্বল এ গমেজ।
বিবার্তা২৪.নেট: সিটিএফএম রেডিও স্টেশনের শুরুর গল্পটা জানতে চাই।
সাইদুর আফতাব: ২০০৮ সালে আমি একটা রাশিয়ান কোম্পানিতে কাজ করতাম। একদিন রাশিয়ান এম্বাবাসির একটা প্রোগ্রামে গিয়েছিলাম। তো রাশিয়ান রাষ্ট্রদূত আমাকে খুব পছন্দ করতেন। সেদিন তিনি আমাকে একটা রেডিও স্টেশন করার প্রস্তাব করেন। অনেক আগে থেকেই আমার দেশের জন্য কাজ করার ইচ্ছা ছিলো। আমার এ ধরনের ইচ্ছা দেখে তিনি আমাকে বললেন তুমি একটা প্রেস কর। প্রেস করলে দেশের জন্য বেশি কাজ করার সুযোগ পাবে তুমি। এর মধ্য দিয়ে তুমি অনেক দূর যেতে পারবে। এখন সরকার রেডিও স্টেশনের লাইসেন্স দিচ্ছে। তুমি করে ফেল না? ওই দিন এ কথা বলেই শেষ। আর কিছু হয়নি।
না হওয়ার কারণে আমার ছোটবেলা থেকে এমন একটা জেদ ছিল, যদি মাথায় একবার কিছু একটা ঢুকে সেটা না হওয়া পর্যন্ত মনে শান্তি পাই না। তাই তথ্য মন্ত্রণালয়ে রেডিও স্টেশন করার জন্য ফোন দিলাম। পরে মন্ত্রণালয় থেকে একটা এপয়েন্টমেন্ট পেলাম। গিয়ে আমি রেডিও স্টেশন করতে চাই কি করতে হবে বললে মন্ত্রণালয় থেকে আমাকে বললেন, রেডিও স্টেশন করতে হলে বিভিন্ন স্থানে আবেদন করতে হবে। বিভিন্ন পর্যায়ে আপনাকে কোয়ালিফাই করতে হবে। তারপরে সব জায়গায় সফলভাবে কোয়ালিফাই করি। ২০১০ সালে সারাদেশে ৮টা এফএম রেডিও স্টেশনের লাইসেন্স দেয় সরকার। এর মধ্যে সিটিএফএম রেডিও ২য় স্থান লাভ করে। ২০১১ সালের জুলাই মাসে লাইসেন্স আমার হাতে আসে। আর আমি সিটিএফএম এর অনএয়ারে দেই ২০১৩ সালের ৩ এপ্রিল। রেডিও স্টেশনটি আমার একার সম্পদ। আর্থিকভাবেও কেউ শেয়ারে নেই। এমনকি এটি উত্তরাধিকার সূত্রে বা পারিবারিক কারো নয়। এটা সম্পূর্ণ আমার নিজস্ব চিন্তায় তৈরি প্রজেক্ট এবং আমার নিজস্ব ব্যবসা।
বিবার্তা২৪.নেট: শুরুতে আপনি কি ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিলেন?
সাইদুর আফতাব: শুরুতে লাইসেন্স পাওয়াটা আমার একার জন্য বিশাল বড় একটা চ্যালেঞ্জের ছিল। আর একটা বিষয় হলো- আপনি যদি প্রেজেন্টেবল হন তাহলে আপনাকে কেউ আটকাতে পারবে না। আমি লাইসেন্স বের করেত কাউকে চারআনা পয়সাও ঘুষ দেইনি। এ স্টেশনটির লাইসেন্স বের করতে গিয়ে সরকারি উচ্চ পর্যায়ের সমস্ত কর্মকর্তারা আমাকে ভালোভাবে সাপোর্ট করেছেন। চ্যালেঞ্জের কথা বললে আর্থিকভাবে তো অনেক চ্যালেঞ্জই এসেছে। কারণ আমার মতো এতো অল্প বয়সে একটা রেডিও স্টেশন করা বিশাল একটা বিষয়। অনেক টাকার দরকার। এটা আমার জন্য বিশাল চ্যালেঞ্জের ছিল। বাকি সব দিক থেকে আমি সবার সাপোর্ট পেয়েছি। আমার অভিজ্ঞতা হলো- কারো কাজের উদ্দেশ্য যদি ভাল থাকে তাহলে সবাই তাকে আন্তরিকভাবে সাহায্য করে।
বিবার্তা২৪.নেট: রেডিও স্টেশনের কার্যক্রমগুলো কিভাবে পরিচালনা করেন?
সাইদুর আফতাব: এফএম রেডিও একটা খুব সহজ ও জনপ্রিয় সম্প্রচার মাধ্যম। অনেকে হয়তো বলবে রেডিও একটা রকেট সাইয়েন্স হিসেবে তৈরি করে। কিন্তু রকেট সাইয়েন্স বলতে কিছুই নাই। আমাদের সিটিএফএম রেডিও স্টেশনে এখন সব বিভাগেরই প্রধান আছে। কিন্তু শুরুতে এরকম কিছুই ছিল না। আমি একাই সব চালাতাম। এখন সিটিএফএম-এর অনএয়ারে তিন বছর চলছে।
এখন সব বিভাগেই পরিচালক নিয়েছি। কিন্তু শুরুর দিকে এটা প্রয়োজন মনে করিনি। কারণ রেডিও ব্যবসাটা অনেক বড় কিন্তু ইনকামটা একদম স্লো। বাংলাদেশের যে কোনো ব্যবসায় তিন বছরের আগে টাকা দেখা যায় না। একটা মেশিন যদি টার্ন অন করেন এটা আর থামে না। চলতে থাকে আপন গতিতে। এটা তো বড় একটা ব্যবসা। বর্তমানে ভাল চলছে। কারণ সব বিভাগে যে যার মতো দায়িত্ব পালন করছে। এখন আমার কোনো টেনশন নাই। এ যেন একটা মেশিন। অন করে দিয়েছি। এখন শুধু চলছে আর চলছে।
বিবার্তা২৪.নেট: সিটিএফএম রেডিও স্টেশনে কি ধরনের প্রোগ্রাম সম্প্রচার করা হয়?
সাইদুর আফতাব: আমরা সব সময় চাই কাস্টমাররা কি চায়। কি পছন্দ করে। কাস্টমাররা যেভাবে চায় সেভাবে আমরা প্রোগ্রাম ডিজাইন করে দেই। সেভাবে সম্প্রচার করি। আমরা অন্যান্য রেডিও স্টেশনের মতো প্রোগ্রাম রেডি করে রেডি প্রোগ্রাম অনএয়ারে দিয়ে কাস্টমারের কাছে যাই না। কাস্টমার যেভাবে চায় আমরা সেভাবে যাই। কাস্টমাররা খুশি হলেই আমরাও খুশি। আমাদের রেডিওতে কথা কম গান বেশি। আমরা কথা বেশি পছন্দ করি না। আমাদের রেডিও খুব ভালো ভাল গান বাজায়। আর একটানা এক ঘন্টা, আধা ঘন্টা প্রোগ্রাম চালাই না।
সিটিএফএম সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে প্রোগ্রাম তৈরি করে। যেমন-মেসে অনেক যুবক থাকে তারা রান্না-বান্না করতে পারে না। ভাত আর আলু এক সাথে সিদ্ধ দেয়। কিন্তু এর সাথে কিছু সবজি দিলে একটা মজার খিচুরি হয়ে যায়। এ নিয়ে নিয়মিত ‘ব্যাচলর রেসিপি’ অনুষ্ঠান করি। তারপর ‘কর্পোরেড লেডি’। আমরা অফিস টু অফিস যাই। গিয়ে জিজ্ঞেস করি আপনি সারাদিন নিজেকে এতো ফ্রেশ রাখেন কিভাবে? এতো ফ্রেশ কিভাবে থাকতে পারেন? তখনি উনি বলে দেন এভাবে। এগুলো মানুষকে ইন্সপায়ার করে।
ডেন্টাল ডক্টর আছে আমাদের। দাঁতের সমস্যায় কি করতে হবে। রতন’স ডেন্টাল ক্লিনিক আছে ওখানে একটা প্রোগ্রাম করেন ‘রতন’স ডেন্টাল’। সেখানে প্রতিদিন ১০টা করে দাঁতের টিপস দেয়া হয়। যেমন- আমি রতন বলছি- দাঁত ভেঙে গেলে এ করবেন, পোকা হলে এ করবেন ইত্যাদি। একদম ফ্রি ভাবে এসব ট্রিটমেন্ট দেই আমাদের রেডিওর মাধ্যমে। যেটা বাংলাদেশের কেউ কখনো করেনি। এক মিনিটের বিজ্ঞাপনে এসব বিষয়গুলো গানের ফাঁকে ফাঁকে বলে দেই। এগুলো শ্রোতাদের বেশি আকর্ষণ করে।
বিবার্তা২৪.নেট: এফএম রেডিওগুলোর প্রোগামের মান নিয়ে নানা মত রয়েছে। প্রোগ্রামের চেয়ে বেশি কথা বলা হয়। এ বিষয়ে আপনার মতামত কি?
সাইদুর আফতাব: আমাদের রেডিও স্টেশনটা খুবই ব্যতিক্রম। আমাদের কথা কম কিন্তু গঠনমূল ও শিক্ষণীয় প্রোগ্রাম বেশি থাকে। কথা না বললে তো আবার শো পরিচালনা করা যায় না। তাই কথা যতটুকু না বললেই নয় ততটুকুই বলা হয়। আমরা চাই কাস্টমারদের রুচি অনুযায়ী অনুষ্ঠান উপহার দিতে। ১২টা রেডিও স্টেশন আছে। ভাল কিছু আইটেম না থাকলে কাস্টামররা সিটিএফএম ৯৬-এ আসবে কেন? আমরা ব্যতিক্রম ও গুণগত মানসম্পন্ন প্রোগ্রাম কাস্টমারদের জন্য তৈরি করি। তাই একবার যারা আমাদের স্টেশনে টিউন করে দ্বিতীয়বার তাকে আসতেই হয়।
বিবার্তা২৪.নেট: সিটিএফএম-এর শ্রোতাদের ফিডব্যাক কেমন?
সাইদুর আফতাব: ভাল। অনেক ভাল। আমি বলব তিন বছরে সিটিএফএম এমন একটা প্লাটফর্ম তৈরি করেছে যে কেউ যদি একবার আমাদের রেডিওতে টিউন করে সে বার বার টিউন করবে। এটা সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে মন্ত্রী লেবেল পর্যন্ত। সবাই আমাদের শ্রোতা। নিয়মিত প্রোগ্রাম শোনে। যেমন একজন মন্ত্রী আমাকে বলেছে তুমি প্রোগ্রামের একটা গান দিয়ে আমাকে ৬২ বছর আগের ইউনিভার্সিটি জীবনে নিয়ে গিয়েছিলে।
বিবার্তা২৪.নেট: সিটিএফএম রেডিওটি শ্রোতাদের কাছে পরিচয় করিয়ে দিলেন কিভাবে?
সাইদুর আফতাব: আমি তেমন বেশি কিছু করি নাই। শুধু গাড়িতে স্টিকার লাগিয়ে দিয়েছিলাম। এছাড়া মার্কেটিং-এর জন্য খুব বেশি ব্র্যান্ডিং করি নি। কারণ ব্র্যান্ডিং করে এক রাতে বাংলাদেশে অনেক কোম্পানি উঠে যায়। আবার পড়েও যায়। ধরে রাখতে পারে না অনেকে। আমি যেহেতু ব্র্যান্ড ম্যানেজমেন্টের স্টুডেন্ট আমি জানি একটা জিনিসকে ব্র্যান্ড করতে ১২-২৪ বছর লেগে যায়। আমি চাই বেশি প্রচার না করে শুধু কাজের মাধ্যমে ব্র্যান্ড হতে। আমি এটাকে অনএয়ারে দিয়ে রাখছি তিন বছরে কেউ না কেউ তো শুনবে। যখন একজন শুনবে সিটিএফএম৯৬ রেডিও ভাল তাহলে সে তো টিউন করবে। আর একটা রেডিও ভাল করতে তো ১০-১২ বছর লাগবে। বিবিসি তো আজকে বিবিসি হয় নাই। ৫০ বছর পার হয়ে গেছে। বা সিএনএন একদিনে সিএনএন হয় নাই। অনেক বছর সময় লেগেছে।
সিটিএফএম৯৬’র প্রতিষ্ঠাতা আফতাবের আত্মবিশ্বাসের গল্প
বিবার্তা২৪.নেট: বাংলাদেশের শ্রোতারা রেডিও স্টেশনের কোনটিকে বেশি গুরুত্ব দেয়? বয়স না প্রোগ্রামের কোয়ালিটি?
সাইদুর আফতাব: বাংলাদেশের মানুষ অভিজ্ঞতা বেশী পছন্দ করে। যখন একটি রেডিও স্টেশনের বয়স ৬ মাস তখন যত ভাল কোয়ালিটির প্রোগ্রামই দেন কিছু আসে যায় না। কোয়ালিটিতে আপনি তেমন কোনো মূল্যায়ন পাবেন না। আর রেডিওর বয়স যখন তিন বছর তখন সবাই বলে, বস ম্যানেজার পাঠাইয়া দেন। বিষয়টা হলো বাংলাদেশের মানুষ দেখতে চায় একজন কোনো প্রতিষ্ঠান শুরু করলে কত দিন ধরে রাখতে পারে। আর আমার অভিজ্ঞতা হলো- মানুষের কাছে কোয়ালিটি নয় অভিজ্ঞতাই বেশি মূল্যবান।
বিবার্তা২৪.নেট: সিটিএফএমকে নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি?
সাইদুর আফতাব: সিটিএফএমকে নিয়ে আমার স্বপ্ন হলো সারা দেশের মানুষ যেন আমাদের প্রোগ্রাম শুনতে পারে সে ব্যবস্থা করতে চাই। এখন সরকার যদি অনুমতি দেয় তাহলে শিগাগরই এটা বাস্তবায়ন করতে চাই। আর এ বছরের মধ্যেই একটি টেলিভিশন চালু করার ইচ্ছা আছে। ইতোমধ্যে প্রায় সব প্রস্তুতি শেষ। বছর শেষের দিকে আশা করছি শুরু করতে পারব। উদ্দেশ্য ভাল থাকলে আমার বিশ্বাস বেশি সময় লাগবে না।
বিবার্তা২৪.নেট: আপনার ব্যস্ততার মাঝেও মূল্যবান সময় দেয়ার জন্য বিবার্তা২৪.নেটের পরিবারের পক্ষ থেকে জানাই কৃতজ্ঞতাপূর্ণ ধন্যবাদ।
সাইদুর আফতাব: আমার জীবনের কথাগুলো আপনাদের নিউজ পোর্টালে প্রকাশ করার জন্য সকলকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
প্রতিবেদনটি বিবার্তায় প্রকাশ হয়েছে। দেখতে যেতে হবে
এই ঠিকানায়।