চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে নতুন দিগন্ত আনতে চায় রোবটযোদ্ধা জয় বড়ুয়া লাভলু

প্রকাশ: বুধবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০২১
https://mail.techvoice24.com/assets/images/logoIcon/logo.png উজ্জ্বল এ গমেজ
https://mail.techvoice24.com/assets/images/logoIcon/logo.png
  ছবি: সংগৃহীত
 স্কুলে পড়ার সময় বন্ধু-বান্ধব ও শিক্ষকরা তাকে নিউটন বলে ডাকতেন। আত্মীয়-স্বজন ও স্কুলের সহপাঠী বন্ধুদের কাছে তিনি পরিচিত ছিলেন খুদে বিজ্ঞানী হিসেবে। কেননা ক্লাস সিক্সে পড়ার সময়ই তিনি বানিয়েছেন প্রথম রোবট। এরপর রোবটিক্স উদ্ভাবনী চিন্তা তার মাথায় ভর করতে থাকে। পড়ালেখার পাশাপাশি একের পর এক বানাতে থাকেন বিভিন্ন রোবটিক যন্ত্র। এখন তিনি অনেকগুলো রোবটিক যন্ত্রের উদ্ভাবক।

এতক্ষণ যার কথা বলছিলাম তিনি হলেন চট্টগ্রামের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে ইলেকট্রনিক্সে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে অধ্যয়নরত জয় বড়ুয়া লাভলু। মানুষের নিত্যদিনের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে নতুন কিছু উদ্ভাবন করা এখন তার নিত্যদিনের কাজ। তবে নানান প্রতিকূল পরিবেশের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলছে তার এই উদ্ভাবনী কার্যক্রম। লাভলুর রোবটিক যন্ত্রের উদ্ভাবক হয়ে ওঠার পেছনে রয়েছে অনেক কথা।


বন্দরনগরী চট্টগ্রামে জন্ম জয় বড়ুয়া লাভলুর। বাবা রবি বড়ুয়া পেশায় একজন আসবাব মিস্ত্রি। মা রীনা বড়ুয়া গৃহিণী। পরিবারে লাভলু দুই ভাইয়ের মধ্যে কনিষ্ঠ।

বাবা নিয়মিত রেডিও শুনতেন। বাসার সে রেডিও নষ্ট হলে বাবা নিজেই খুলে ঠিক করতেন। তিনি বাবার এসব কাজ গভীর মনোযোগ সহকারে দেখতেন। শিশুমনে কৌতূহল হতো তার। সে কৌতূহল মেটাতে মাঝেমধ্যে বাসার ব্যবহৃত ইলেকট্রনিক্সের জিনিস খুলে আবার সেটা লাগাতেন। ছেলের আগ্রহে বাবাও সায় দিতেন। দিন দিন তার আগ্রহ বাড়তে থাকে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় মাথায় আসে উদ্ভাবনী চিন্তা। বানিয়ে ফেললেন প্রথম রোবট। নাম দেন হোম ক্লিনিং রোবট। ঘরদোর পরিষ্কার করতে সক্ষম সে রোবট।

রোবট বানানোর চিন্তার শুরুটা কীভাবে? জবাবে লাভলু বলেন, ছোটবেলা থেকেই পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশনের খবরে বিভিন্ন সময়ে যখন উন্নত দেশগুলোর বানানো বুদ্ধিমান রোবটের চিত্র দেখতাম, তখন মাথায় কাজ করতো এটা কী করে বানানো যায়। বিষয়টা নিয়ে ইন্টারনেটে পড়াশোনা, গবেষণা করতাম। রোবট জগত নিয়ে যত জেনেছি, তত বেশি কৌতূহল ও আগ্রহটাও বেড়েছে। সে জ্ঞানকে বাস্তবে প্রয়োগ করে কিছু না কিছু তৈরির চেষ্টায় সবসময় খুঁটিনাটি যন্ত্রাংশ নিয়ে লেগে থাকতাম। কখনো কিছু হতো। আবার কখনো ব্যর্থ হতাম। এভাবে বিরামহীন চেষ্টা করে হোম ক্লিনিং রোবটটা বানিয়ে ফেলি।

সেই ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় থেকে তার শুরু। লাভলু এখন ইলেকট্রনিকসে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং করছেন চট্টগ্রামের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে। পড়াশোনার পাশাপাশি রোবটিক্স নিয়ে আছে তার অসংখ্য কাজ। এরই মধ্যে বানিয়েছেন হোম ক্লিনিং রোবট। কৃষক সহায়তায় উদ্ভাবন করেছেন উভচর রোবট, রোবটিক থার্ড হ্যান্ড, ওয়্যারলেস হ্যান্ড, ইএমজি কন্টোল রোবটিক হ্যান্ড, হেড মেসেজ ডিভাইজ, এলিন ওয়ান ফিউচার কার, রোপ ক্যামেরা, ওয়্যারলেস ক্যামেরা, কথা বলা রোবট, রোবটিক্স মুখ ইত্যাদি।

মূলত অঙ্গহীন মানুষের সুবিধার্থে স্নায়ুতন্ত্রকে ব্যবহার করে এ রোবোটিক্স অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তৈরি করছেন এই উদ্ভাবক।

এসব একাই বানিয়েছেন আত্মপ্রত্যয়ী লাভলু। শুধু তাই নয়, তিনি রোবলাইফ টেকনোলজি সেন্টার নামে একটি অর্গানাইজেশনও গড়ে তুলেছেন। এ প্রতিষ্ঠানে তিনি স্কুলশিক্ষার্থীদের রোবটিক্স ধারণা দেন। মানুষের মতোই দেখতে একটা রোবট আছে লাভলুর তৈরি। এই রোবট চোখের পলক ফেলতে এবং মুখ নাড়াতেও সক্ষম।

লাভলু এতগুরো উদ্ভাবনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সাড়া জাগানো উদ্ভাবন হলো তার ইএমজি কন্ট্রোল হ্যান্ড। উদ্ভাবনের পর নিজের হাতে লাগিয়ে পরীক্ষা করেন। পরে চট্টগ্রামের সোইলো চাকমা নামের আরেক তরুণ, যার কনুই থেকে হাত পর্যন্ত নেই, এমন একজনের হাতে লাগিয়ে পরীক্ষা করে সফল হন।

লাভলু বলেন, কৃত্রিম হাত যখন সোইলো চাকমার হাতে কাজ করছিল, তখন তিনি কান্না জুড়ে দেন। তার এই কান্না দেখে আনন্দে আমার চোখেও পানি চলে আসে।

স্নায়ুবিক আবেদনে সাড়া দিতে সক্ষম এমন রোবোটিক্স হ্যান্ড তথা কৃত্রিম হাত তৈরির গল্প বলতে গিয়ে লাভলু বলেন, ২০১৭ সালের কথা। সবেমাত্র এসএসসি শেষ করেছি। হঠাৎ একদিন বাড়ির পাশের রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় দেখি এক প্রতিবেশীর হাত নেই। গামছা দিয়ে হাতটি ঢেকে রেখেছেন। দেখে খুব কষ্ট পাই। মনে মনে ভাবি কী করে এই প্রতিবেশীর মনের কষ্টটা দূর করা যায়। মাথায় চিন্তা আসে কৃত্রিম রোবটিক হাত বানিয়ে উনার মনের কষ্টটা দূর করা যায় কিনা।

শুরুতে বাবা-মার কাছ থেকে টাকা নিয়ে বিভিন্ন যন্ত্রাংশ কিনি। অধিকাংশ যন্ত্রাংশ দেশে পাওয়া যায় না বলে চড়া দামে বিদেশ থেকে নিয়ে আসি। এখন আমার কৃত্রিম হাতের চারটা প্রজেক্ট আছে।

লাভলুর এই কৃত্রিম হাত অবিকল সুস্থ মানুষের হাতের মতোই কব্জি থেকে শুরু করে আঙুলগুলো নড়াচড়া করতে পারে। ইচ্ছেমতো, যেকোনো দিকে ঘোরানো যায়, করা যায় মুষ্ঠিবদ্ধও। এটি দিয়ে যেকোনো জিনিস ধরে ওপরে তোলার কাজ করা যায়। হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে পানি তুলেও খাওয়া যায়। লোহা ফ্যাক্টরিসহ বিপজ্জনক জায়গায় যারা কাজ করেন, তারা এই রোবটিক হাত ব্যবহার করতে পারবেন। ব্রেইন থেকে আসা সিগন্যাল এই হাত গ্রহণ করে। জন্মগতভাবেই যাদের হাত নেই। কনুই থেকে কিংবা হাতের পাতা নেই- সবাই লাভলুর এই বিশেষ হাতের সুবিধা নিতে পারবেন।

খুদে বিজ্ঞানী লাভলুর ভাষ্য, যারা বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটে কাজ করেন কিংবা বিভিন্ন লোহা ফ্যাক্টরিতে এবং নানারকম বিপদজনক কাজ করেন তারা এই রোবটিক্স ওয়ারলেস হাত ব্যবহার করতে পারবেন। এটা কন্ট্রোল করা যাবে মানুষের হাতের সাথে লাগানো একটি ট্রান্সমিটার হাতের সাহায্য। এর ফলে যে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে শ্রমিকরা তাদের হাতকে বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারবেন।

সেই সাথে যারা শারীরিক প্রতিবন্ধকতার শিকার, তাদের জন্য এটা খুবই উপকারী হতে পারে। মাত্র ১৫ হাজার টাকা খরচ পড়েছে হাতটি তৈরি করতে। এতে বেশকিছু সেন্সর ব্যবহার করা হয়েছে। ট্রান্সমিট সিস্টেমের মাধ্যমে এবং মানুষের পেশির সিগন্যালের মাধ্যমে কাজ করে। যার হাত নেই, সেও এটি ব্যবহার করতে পারবে। আবার অনেক সময়ই হাই-ভোল্টেজ ইলেকট্রিকসহ বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ‘তৃতীয় হাত’ দরকার হয়, সেক্ষেত্রেও এটি উপকারী হবে।

প্রতিটি কাজের পেছনেই লাভলুর উদ্দেশ্য হলো, কম খরচে তৈরি করা এসব যন্ত্র যেন সাধারণ মানুষের কাজে লাগে। রোবটিক হাতের মতো প্রযুক্তি যেন দরিদ্র মানুষ স্বল্পমূল্যে কিনে ব্যবহার করতে পারেন। মানুষের উপকারে এলেই তার এই প্রচেষ্টা সফল হবে বলে জানালেন খুদে রোবট এই বিজ্ঞানী।

নিজের উদ্ভাবনী মেধার স্বীকৃতি হিসেবে এরমধ্যে তার অর্জনের ঝুলিতেও যোগ হয়েছে বেশ কয়েকটি পুরস্কার। ২০১৯ সালে নাসা স্পেস অ্যাপ চ্যালেঞ্জে চট্টগ্রাম থেকে প্রথম স্থান অর্জন করে লাভলু ও তার দল। এ ছাড়া চ্যানেল আইএসো রোবট বানিয়ে টিভি শোতে এগ্রিকালচার রাউন্ডে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন লাভলু। ইলেকট্রনিকস সেফটি অ্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের উদ্যোগে আয়োজিত বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত ‘আবিষ্কারের খোঁজে’ প্রতিযোগিতায় ফার্স্ট রানারআপের পুরস্কার পান তিনি।

এ ছাড়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত প্রতিযোগিতা, চট্টগ্রাম ও হাটহাজারীতে স্থানীয়ভাবে আয়োজিত বিজ্ঞান মেলা ও বিজ্ঞান প্রতিযোগিতায়ও পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার। এছাড়াও একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেল তাকে নিয়ে তৈরি করেছে ডকুমেন্টারি। সেই ডকুমেন্টারি দেখেছেন প্রায় দুই কোটির বেশি মানুষ। অন্যদিকে গাজিপুরে ঊর্মি গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিসের সকল অটোমেশন কাজকে রোবটিক সেক্টরে আনার জন্য দায়িত্ব পেয়েছেন লাভলু।

তরুণ এই উদ্ভাবকের প্রতিটি উদ্ভাবনই সম্ভাবনাময়। কিন্তু পৃষ্ঠপোষকতা নেই। ফলে এসব কিছু বাণিজ্যিকভাবে বাজারে আসার পথ রুদ্ধ। আর্থিকভাবে তার সামর্থ্য নেই এগুলো বাজারজাতকরণের। লাভলু বলেন, দেশে বর্তমানে যারা বাইরে থেকে কৃত্রিম হাত নিয়ে আসেন, তাদের একেকটি হাতের পেছনে খরচ হয় প্রায় ছয় লাখ টাকা। অথচ মাত্র ৫০ হাজার টাকা খরচ হবে আমার এই সম্পূর্ণ কৃত্রিম হাত তৈরিতে। রোবটিক কাজে প্রায় সব যন্ত্রাংশ দেশের বাইরে থেকে আনতে হয়। এ জন্য খরচ অনেক বেশি পড়ে।

দরিদ্র মানুষ। হাত নেই। তারা কম খরচে লাভলুর হাত ব্যবহার করতে পারবেন। মানুষ যাতে উপকৃত হন। হাতহীন জীবনে রোবটিক হ্যান্ড আশীর্বাদ হয়ে আসবে- এমনটাই ভাবনা লাভলু।

তিনি বলেন, আমি চাই আমার নিজের হাতে বানানো হাত, হাত না থাকা মানুষের স্বপ্নের হাত হয়ে কাজ করুক। আমার মেধা এবং শ্রম দিয়ে মানুষের জন্য সামান্য কিছু করতে পারলেও আমি নিজেকে সার্থক মনে করব।

লাভলু জানালেন, পরিবারে কিছুটা আর্থিক অভাব-অনটন থাকায়, নতুন কিছু উদ্ভাবনের ইচ্ছা থাকলেও সেগুলি করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। এজন্য প্রয়োজন পৃষ্ঠপোষকতার। তবে পরিবারের সদস্যরা সবসময় তাকে উৎসাহ দেন, কাজে সহযোগিতা করেন।

ছেলে বড় হয়ে একদিন বড় রোবট বিজ্ঞানী হবে বলে স্বপ্ন দেখেন লাভলুর গর্বিত বাবা-মা। এই কাজটা এতো সহজ নয়। এর জন্য প্রচুর পড়াশোনা ও গবেষণা করতে হবে। অনেক টাকা লাগবে। ছেলে যেসব রোবটিক্স উদ্ভাবন করছেন সেগুলোর উপকরণ কিনতে অনেক টাকার দরকার। এর জন্য অবশ্য ইতিমধ্যে আর্থিকভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ এবং বেসরকারি এক কোম্পানি। চায়না থেকে কিছু রোবটিক্স যন্ত্রপাতি কেনার জন্য আর্থিকভাবে সহায়তা করেছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ।

লাভলুর ইচ্ছা ডিপ্লোমা শেষ করে ঢাকা প্রযুক্তি ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢুয়েট) রোবোটিক্স সম্পর্কিত কোনো বিষয়ে পড়াশোনা করার। সেই সাথে ভবিষ্যতে একটি বড় রোবোটিক্স প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেন তরুণ এই উদ্ভাবক। যেখানে নানা রকম উন্নত প্রযুক্তি আর সব রোবটিক্স বিষয়ে গবেষণা করা হবে। যেখান থেকে নতুন প্রজন্মকে রোবটিক্স বিষয়ে ধারণা দেয়া হবে। স্বপ্ন পূরণে অংশ হিসেবে ইতোমধ্যেই রোবলাইফ টেকনোলজি সেন্টার নামে একটি অর্গানাইজেশনও চালু করেছেন। ওই প্রতিষ্ঠানে তিনি স্কুলশিক্ষার্থীদের নিয়ে রোবোটিক্স সম্পর্কে নানা রকম ধারণা দিচ্ছেন।

image

আপনার মতামত দিন