বর্তমানে স্যাটেলাইটভিত্তিক ইন্টারনেট সেবা প্রদানে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে ইলন মাস্কের প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্স। অন্যদিকে, এই খাতে নিজেদের অবস্থান মজবুত করতে বিশাল বাজেট নিয়ে কাজ করছে অ্যামাজন, যার নেতৃত্বে রয়েছেন প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোস। আর তাই একে বলা চলে মহাকাশে প্রযুক্তির দুই দানবের দ্বৈরথ, যেখানে প্রতিযোগিতা সত্ত্বেও নির্ভরতা তৈরি হচ্ছে একে অপরের উপর।
প্রতিদ্বন্দ্বীর রকেটে ভর করে অ্যামাজনের স্যাটেলাইট
সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত সিএনবিসি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অ্যামাজন তাদের ‘প্রজেক্ট কুইপার’ উদ্যোগের আওতায় ২৪টি স্যাটেলাইট মহাকাশে পাঠানোর পরিকল্পনা নিয়েছে। তবে সবচেয়ে চমকপ্রদ দিক হলো, এই স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করা হবে স্পেসএক্সের ‘ফ্যালকন ৯’ রকেটের মাধ্যমে-যেটি কিনা মাস্কের কোম্পানির নিজস্ব প্ল্যাটফর্ম এবং অ্যামাজনের সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বী।
এই উৎক্ষেপণ পরিকল্পনার নাম ‘KF-01 মিশন’, যার জন্য ২৭ মিনিটের সময়সূচি নির্ধারণ করা হয়েছে। এটি ফ্লোরিডার স্পেস কোস্ট থেকে পরিচালিত হবে এবং ইলন মাস্কের মালিকানাধীন সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ‘X’-এ সরাসরি সম্প্রচার করা হবে।
স্টারলিংকের একচ্ছত্র আধিপত্য
বর্তমানে স্পেসএক্সের ‘স্টারলিংক’ প্রকল্পে প্রায় ৮ হাজার স্যাটেলাইট রয়েছে পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে। বিশ্বজুড়ে তাদের গ্রাহকসংখ্যা প্রায় ৫০ লাখ, যা তাদেরকে স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবার শীর্ষস্থানীয় কোম্পানিতে পরিণত করেছে। এই অবস্থানে পৌঁছাতে মাস্ক তার প্রতিষ্ঠানকে পরিণত করেছেন সাশ্রয়ী ও পুনর্ব্যবহারযোগ্য রকেট প্রযুক্তির অগ্রগামীতে।
অ্যামাজনের চ্যালেঞ্জ ও সময়সীমা
অ্যামাজনের ‘প্রজেক্ট কুইপার’ ২০১৯ সালে যাত্রা শুরু করে, যার লক্ষ্য ৩,২০০-এর বেশি স্যাটেলাইট দিয়ে বিশ্বব্যাপী ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সুবিধা দেওয়া। তবে এখন তারা যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল কমিউনিকেশনস কমিশন (FCC)–এর এক কঠোর সময়সীমার মধ্যে পড়েছে।
এফসিসির নিয়ম অনুযায়ী, ২০২৬ সালের জুলাইয়ের মধ্যে অন্তত ১,৬০০ স্যাটেলাইট কক্ষপথে স্থাপন করতে না পারলে লাইসেন্স হারাতে পারে অ্যামাজন। এই সময়সীমা পূরণের চাপের মধ্যে পড়েই স্পেসএক্সের সহায়তায় দ্রুত উৎক্ষেপণের পথ বেছে নিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।
উৎক্ষেপণ পরিসংখ্যান ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
এপ্রিল ও জুন মাসে অ্যামাজন প্রথম দুটি উৎক্ষেপণে যথাক্রমে ২৭টি করে কুইপার স্যাটেলাইট পাঠিয়েছে, যেগুলো উৎক্ষেপণ করেছিল ইউনাইটেড লঞ্চ অ্যালায়েন্স (ULA)। বুধবারের পরিকল্পিত উৎক্ষেপণ সফল হলে, পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে অ্যামাজনের মোট ৭৮টি স্যাটেলাইট থাকবে।
প্রজেক্ট কুইপার বাস্তবায়নে ইতোমধ্যে অ্যামাজন ৮৩টি উৎক্ষেপণের চুক্তি করেছে, যার মধ্যে তিনটি উৎক্ষেপণ পরিচালনা করবে স্পেসএক্স। লক্ষ্য একটাই-FCC-র নির্ধারিত সময়ের আগেই ন্যূনতম স্যাটেলাইট সংখ্যা কক্ষপথে পাঠিয়ে লাইসেন্স ধরে রাখা।
বেজোস বনাম মাস্ক: প্রতিযোগিতা ও নির্ভরতা
মহাকাশ এখন শুধুই বৈজ্ঞানিক গবেষণার ক্ষেত্র নয়-এটি পরিণত হয়েছে বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতার ময়দানে। এখানে রয়েছে জেফ বেজোস ও ইলন মাস্কের মধ্যকার সুস্পষ্ট দ্বৈরথ। অ্যামাজনের কুইপার প্রজেক্টের পাশাপাশি, বেজোসের নিজস্ব মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ব্লু অরিজিন’-ও কাজ করছে পুনর্ব্যবহারযোগ্য রকেট প্রযুক্তি নিয়ে।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে ব্লু অরিজিন তাদের ‘নিউ গ্লেন’ রকেটের প্রথম পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণ সম্পন্ন করেছে, যা স্পেসএক্সের ফ্যালকন ৯ রকেটের প্রতিযোগী হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। যদিও স্পেসএক্স এখনো অনেক এগিয়ে, বেজোস জানিয়েছেন, ‘ব্লু অরিজিন একদিন অ্যামাজনের থেকেও বড় হবে।’
বাজেট ও বিনিয়োগ
প্রজেক্ট কুইপার বর্তমানে অ্যামাজনের অন্যতম বড় বাজির জায়গা। প্রাথমিকভাবে এর জন্য বরাদ্দ ছিল এক হাজার কোটি ডলারের বেশি। কিন্তু সাম্প্রতিকভাবে ব্যাংক অব আমেরিকার বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, পুরো স্যাটেলাইট নেটওয়ার্ক তৈরি করতে অ্যামাজনের ব্যয় দুই হাজার তিনশ কোটি ডলার পর্যন্ত হতে পারে।
প্রযুক্তির নতুন সীমান্তে অ্যামাজন ও স্পেসএক্সের প্রতিযোগিতা যেমন তীব্র, তেমনি বাস্তবতা তাদের মাঝে নির্ভরতার সম্পর্কও তৈরি করছে। এই দ্বৈরথ ভবিষ্যতের ইন্টারনেট সেবা ও মহাকাশভিত্তিক অবকাঠামোর গতিপথ নির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখবে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা। সূত্র: সিএনবিসি