অসংযুক্তদের সংযুক্ত করে বাংলাদেশে একটি বহুভাষিক ইন্টারনেট ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার প্রত্যয়ে তৃতীয় ইউনিভার্সেল অ্যাকসেপ্টেন্স দিবসে উন্মোচিত হলো `বাংলা ইমেইল'।
দিবসটি উদযাপন উপলক্ষে মঙ্গলবার (১৫ এপ্রিল) বিটিআরসি ভবনের সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত কারিগরি কর্মশালা ও বিশেষ সম্মেলনে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থার বাংলা ওয়েব ঠিকানা বিটিআরস ডট বাংলা এবং নিজের নামে তৈরি বাংলা ইমেইল ঠিকানা উন্মোচন করেন বিটিআরসি চেয়ারম্যান এমদাদ উল বারী।
এর মাধ্যমে পূর্ণতা পেলো বিটিআরিস ডট বাংলা ডোমেইন। একইসঙ্গে নিজেদের বাংলা নামে ই-মেইল করার সুযোগ পেলেন তারা। উন্মোচিত হলো বাংলা অক্ষরে ই-মেইল খোলার সুযোগ।
বাংলাদেশ ইন্টারনেট গভর্ন্যান্স ফোরাম (BIGF) এবং বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (BTRC) এবং ইন্টারনেটের ডোমেইন ঠিকানা বরাদ্দকারী সংস্থা ইন্টারনেট করপোরেশন ফর অ্যাসাইনড নেমস অ্যান্ড নাম্বারসের (আইকান) সহযোগিতায় অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সরকারি, শিল্প, একাডেমিক, গণমাধ্যম এবং সিভিল সোসাইটির বিভিন্ন প্রতিনিধিরা।
অনুষ্ঠানে ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তির বিকাশ এবং বাংলা ভাষায় ডোমেইন (.বাংলা), ইমেইল ঠিকানা (@বাংলা) এবং স্থানীয় ডিজিটাল পরিচিতি ব্যবহারের গুরুত্ব তুলে ধরা হয়।
এসময় প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিটিআরসি চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মো. এমদাদ উল বারী বলেন, ‘যোগাযোগের জন্য মাতৃভাষা হচ্ছে সর্বোত্তম। অন্য ভাষায় নিজেকে প্রকাশ করতে গেলে তা আরো জটিল হয়ে ওঠে। কেননা, বিমূর্ত বিষয় এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিষয় অন্য ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।’
সভ্যতা ও প্রযুক্তি ভাষাকে টিকিয়ে রাখে তিনি আরো বলেন, ‘এজন্য গবেষণার কোন বিকল্প নেই। সবাই যেন সহজে বাংলায় ফার্স্ট টাইম কনটেন্ট আপলোড করতে পারে সেজন্য বাংলা এআই এলএলএম তৈরি করতে হবে। ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে কানেক্টিভিটি গ্যাপ কমাতে এবং প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। সর্বোপরি আন্তর্জাতিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে প্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা বন্ধ হতে হবে।’
বিশেষ অতিথি ছিলেন বিটিআরসি পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড অপারেশনস), ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শফিউল আজম পারভেজ। অনলাইনে যুক্ত হয়ে বক্তব্য দেন আইকান ভাইস প্রেসিডেন্ট সমীরণ গুপ্ত ও আইকান বোর্ড পরিচালক মো. সাজিদ রহমান।
সমীরণ গুপ্ত বলেন, ‘যারা ইংরেজি বা বিদেশী ভাষায় দুর্বল তাদের জন্য বহুভাষিক ইন্টারনেট সুবিধাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিষয়টি বিটিআর-বিআইজিএফ ইউনিভার্সেল একসেপ্টেন্স এর জন্য গুরুত্বের সঙ্গে নেয়ায় আইকান প্রকৌশল ও কারিগরি সহায়তায় প্রস্তুত রয়েছে। এ জন্য আমরা ১৬ ঘণ্টার একটি ইনক্লুসিভ ট্রেনিং এর ব্যবস্থা রেখেছি।’
সাজিদ রহমান বলেন, ‘ইন্টারনেট সবাইকে এক সুতোয় বাধার জন্য শুরু হলেও ইন্টারনেট এখন ডিজিটাল অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করেছে। এখানে ভাষা ও সংস্কৃতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যদি অন্তর্ভূক্তিমূলক ডিজিটাল ভবিষ্যত গড়তে চাই, তবে গ্রামের মানুষের জন্য ইন্টারনেটকে বাংলাভাষা বান্ধব হতে হবে।’
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন বিআইজিএফ সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ আবদুল হক আনু।
এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আইসিটি বিভাগের পরামর্শক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ মামুন অর রশিদ এবং ইউনিভার্সাল অ্যাকসেপ্টেন্স এর কারিগরি দিকের ওপর আলোকপাত করেন বিটিআরসি’র উপপরিচালক ড. শামসুজ্জোহা।
এছাড়াও কারিগরি সেশনে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে UA, IDNs এবং EAI বিষয়ে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দেন ICANN-এর এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের টেকনিক্যাল এনগেজমেন্ট ম্যানেজার চাম্পিকা উইজয়তুনগা।
মূল উপস্থাপনায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়-এর বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ মামুনুর রশীদ বলেন, ‘বাংলায় বহু ভাষায় ইন্টারনেট কেন্দ্রিক কনটেন্ট, ইন্টারফেস এবং বিভিন্ন ভাষায় ইন্টারনেট ব্যবহার ও প্রবেশাধিকার এর সুযোগ নিশ্চিত করা জরুরি।
তিনি বলেন, ‘ইন্টারনেট জগতে ৪৯.২ ভাগ কনটেন্ট ইংরেজি, ৬ ভাগ স্পেনিশ এভং ৪.৫ ভাগ ফ্রান্স ভাষা, যার ফলে বহু দেশের বহু ভাষার মানুষ তার নিজস্ব ভাষায় কনটেন্ট ব্যবহার করতে পারছে না।’
এআই মডেলগুলো ইংরেজি ও পশ্চিমা ভাষার ওপর বেশি জোর দিয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘প্রযুক্তির প্রাণ হলো ডমেইন নেইম, তাই বাংলায় ডোমেইন চালু করা হলে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী নিজ ভাষায় ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারবে।’
ড. শামসুজ্জোহা জোহা বলেন, ‘২০২৬ সালে নতুন করে টপ লেভেল ডোমেইন বরাদ্দ দেয়া শুরু হবে। ফলে এই সুবিধাটা কাজে লাগাতে দেশের প্রকৌশলী ও উদ্যোক্তাদের সামনে সুযোগ আসছে। এজন্য সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে বাংলা ভাষা প্রযুক্তির উন্নয়নে কাজ করতে হবে। সচেতনার পাশাপাশি কারিগরি দক্ষতা অর্জনে মনোনিবেশ করতে হবে।’
এছাড়াও উপস্থানায় ইউএ-এর টেকনিক্যাল চ্যালেঞ্জ তুলে ধরেন বিটিসিএল এর ডোমেইন ডিভিশনের ম্যানেজার মোস্তফা আল মামুন। লিন্যাক্সে ডট বাংলা ব্যবহারের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন আম্বার আইটি’র মাহফুজুর রহমান।
তারা জানান, ডিএনএস সার্ভারে বাংলা ভাষা পানিকোড থেকে কনভার্ট করতে হয় এবং এক্ষেত্রে সাইবার ঝুঁকির বিষয় তুলে ধরা হয়। জানানো হয়, এখনো লিনাক্সে বাংলা ইউনিকোড সমর্থন করে না। বাংলা ই-মেইলকে জিমেইল স্প্যাম হিসেবে দেখায়। ফলে সফটওয়্যার প্রকৌশলে অনেক কাজ করতে হবে।
আমিনুল হাকিম বলেন, ‘ডাটা সেন্টার হাব হিসেবে আসতে পারে। কনটেন্ট তৈরি করতে পারলে ডিজিটাল ডিভাইড কমে আসবে এবং ইন্টারনেট উতপাদনমুখী কাজে ব্যবহার হবে।’
সমাপনী বক্তব্যে উপস্থিত সবাইকে অনলাইন ঠিকানার গুরুত্ব বুঝে এর কারিগরি দক্ষতা অর্জনে অংশগ্রহণকারী ও আয়োজকদের প্রতি ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন বিটিআরসি’র কমিশনার (ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড অপারেশনস) ব্রিগ. জেনারেল ইকবাল আহমেদ (অব.)।
সভাপতির বক্তব্যে বিআইজিএফ চেয়ারপার্সন মোহাম্মদ আমিনুল হাকিম বলেন, ‘বাংলায় সব প্লাটফর্মের উপযোগী কনটেন্ট তৈরি করতে পারলে ডিজিটাল ডিভাইড কমে আসবে এবং ইন্টারনেট উৎপাদনমুখী কাজে ব্যবহার হবে।’
প্রসঙ্গত, অনলাইনের সব বৈধ ডোমেইন ও ইমেইল ঠিকানায় থাকা কন্টেন্ট যেন ভাষা, স্ক্রিপ্ট বা দৈর্ঘ্যের বৈষম্য ঘুচে সমানভাবে ইন্টারনেট-সক্ষম সকল অ্যাপ্লিকেশন, ডিভাইস ও সিস্টেমে কাজ করে তার একটি কারিগরি মানদণ্ড নিশ্চিত করে ইউনিভার্সাল অ্যাকসেপ্টেন্স। .বাংলা ডোমেইনের প্রসার এবং স্থানীয় ভাষাভিত্তিক ডিজিটাল পরিচয়ের বিকাশে বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃত এই কারিগরি মানদণ্ড (ইউএ)অপরিহার্য। সেই বিবেচনায় বাংলাদেশে একটি ভাষা-ভিত্তিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং আধুনিক ইন্টারনেট ইকোসিস্টেম গড়তে দিবসটির তাৎপর্য ক্রমেই বাড়ছে। বাংলা ভাষায় ইন্টারনেট কেন্দ্রিক ইন্টারফেস এবং বিভিন্ন ভাষায় ইন্টারনেট ব্যবহার ও প্রবাসী অধিকার নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়।