বয়স তোমার ২৮, শুধু কি সংখ্যা, না যোগ্যতায়?

প্রকাশ: মঙ্গলবার, ২৭ মে, ২০২৫
https://mail.techvoice24.com/assets/images/logoIcon/logo.png টেকভয়েস২৪  ডেস্ক
https://mail.techvoice24.com/assets/images/logoIcon/logo.png
  ছবি: সংগৃহীত
দেশের সৃজনশীল খ্রিস্টান লেখক, কবি-সাহিত্যিক ও মুক্ত চিন্তা-চেতনাসম্পন্ন মানুষদের ২৮ বছরের পুরানো সংগঠন বাংলাদেশ খ্রিস্টান লেখক ফোরাম। অন্য পাঁচটা সম্প্রদায়-ভিত্তিক সংগঠনের মতো নানা চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্য দিয়ে এর যাত্রা শুর হয়। সংগঠনটির দীর্ঘ পথ-পরিক্রমায় রয়েছে সুখ ও দুঃখ গাঁথার এক বর্ণাঢ্য ইতিহাস। এখানে রয়েছেন খ্রিস্টান সম্প্রদায়ে গর্ব, অসংখ্য বিখ্যাত, প্রসিদ্ধ ও গুণী লেখক, গবেষক, কবি, সাহিত্যিক, নাট্য পরিচালক, অভিনেতা, কলামিস্ট ও সাংবাদিক।

স্বপ্নবাজ মানুষের চিন্তা থেকে যাত্রা শুরু হয় সংগঠনের
দুই বা তিনজন স্বপ্নবাজ মানুষের চিন্তা থেকে যাত্রা শুরু হয় যেকোনো সংগঠন বা ফোরামের। যাত্রার শুরুর পথটা কখনো মসৃণ হয় না। চায়ের আড্ডায়, কোনো গাছতলায় গল্পোচ্ছলে হঠাৎ একজনের মাথায় চিন্তার উদয় হয়। সেই ভাবনা থেকেই শুরু হয় পরিকল্পনার। দফায়, দফায় চলে মিটিং-সিটিং, আড্ডা ও আলোচনা সভা। অর্থপূর্ণ “নাম” নির্বাচন। কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে লেখা হয় গঠনতন্ত্র। সে অনুসারে কার্যনির্বাহী পরিষদ গঠন। শুরু হয় আনুষ্ঠানিক যাত্রা।

তিন স্বপ্নদ্রষ্টার সম্মিলিত চিন্তার ফসল
বাংলাদেশ খ্রিস্টান লেখক ফোরামও এর ব্যতিক্রম নয়। গুণী কবি, সাহিত্যিক, গীতিকার সুবীর কাস্মীর পেরেরা, কবি, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক ভিক্টর কে. রোজারিও এবং কলাম লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী সঞ্জীব দ্রং এই তিন স্বপ্নদ্রষ্টার সম্মিলিত চিন্তা ও প্রচেষ্টার ফসল এই লেখক ফোরামটি। প্রতিষ্ঠাতা সভাপতিসহ কার্যনির্বাহী পরিষদের সকল সদস্য ও সাধারণ সদস্যরা একটা নতুন ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছেন। কালের যাত্রায় সংগঠনটির কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা রক্ষায় বিভিন্ন মেয়াদে বেশ কয়েকটি কার্যনির্বাহী পরিষদ দায়িত্ব পালন করেছেন। সকল কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্যদের প্রতি রইল সশ্রদ্ধ অভিনন্দন।

তাঁদের কাজেও রেখে যেতে হয় পদহিহ্ন
সম্মানিত সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্যরা, সংগঠন ও সাধারণ সদস্যদের কল্যাণে এবং উন্নয়নে কাজ করবেন বলে প্রতিজ্ঞা করেন। তাই তাঁদের কিছু নৈতিক দায়িত্ব থাকে। পুরো মেয়াদে সাংগঠনিকভাবে আয়োজিত ও অনুষ্ঠিত সকল কার্যক্রমের বিষয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন আকারে রেজিস্টার খাতায় লেখা, প্রকাশনার খরচ ও কেনাকাটার বিল-ভাউচার সংরক্ষণ করা, নিয়মতান্ত্রিকভাবে সব কার্যনির্বাহী পরিষদের সংশ্লিষ্ট কমিটির অন্যতম নৈতিক দায়িত্ব। বার্ষিক সাধারণ সভায় কোন সদস্য যেকোনো অনুষ্ঠান বা কেনাকাটার খরচের বিষয়ে জানতে চাইলে যেনো কোষাধ্যক্ষ তাৎক্ষণিকভাবে ওই বিলের কাগজ দেখাতে পারেন। যেকোনো সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালনায় আর্থিক লেন-দেনের হিসেবের স্বচ্ছতা থাকাটা জরুরি। কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্যরা নিজ নিজ দায়িত্ব সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে পালন করলে পরের মেয়াদে পরিষদের সদস্যদের দায়িত্ব পালনে কোন সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় না।

প্রতিটি মেয়াদে যেসকল কার্যক্রম সম্পন্ন হয়ে থাকে, সেগুলো ধারাবাহিকভাবে রেজিস্টার খাতায় লেখা। সাংগঠনিকভাবে সকল সভা-সমাবেশ, আলোচনা ও প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠান, বার্ষিক বনভোজন, প্রকাশনার যত প্রকার খরচ করা হয়, সব ধরনের কেনাকাটায় বিল-ভাউচারের কাগজ সংরক্ষণ করা, বিস্তারিত লেখা দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। বার্ষিক সাধারণ সভায় কোন সদস্য যেকোনো অনুষ্ঠানের খরচের বিষযে জানতে চাইলে যেনো কোষাধ্যক্ষ তাৎক্ষনিক বিলের কাগজ দেখাতে পারেন। যেকোনো সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালনায় আর্থিক লেন-দেনের হিসেবের স্বচ্ছতা থাকাটা জরুরি।

কাগজ কলমবিহীন ওয়েবে থাকুক না সংগঠনের তথ্য
সময়ের সাথে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে বাংলাদেশ খ্রিস্টান লেখক ফোরামের নতুন কার্যনির্বাহী পরিষদকে কার্যক্রম, কর্মপরিকল্পনা বা স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যান ও রোডম্যাপে আনতে হবে সময়োপযোগী উদ্ভাবনী চিন্তার প্রতিফলন। মান্ধাতা আমলের মতো এখন আর রেজিস্টার খাতায় কার্যক্রমের প্রতিবেদস লিখলে আর হিসেব করলে হবে না। এখন সবকিছু কাগজ কলমবিহীন সফটওয়ার ও ওয়েব নির্ভর হয়েছে।

যুগের সাথে তাল মিলিয়ে এখন সবকিছু লিখতে হবে ওয়েবে ও হিসেব সংরক্ষণ করতে হবে সফ্টওয়ারে। সংগঠনের জন্য থাকতে হবে একটা অফিসিয়াল ওয়েবসাইট। যেখানে থাকবে সংগঠনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। শুরু থেকে এ পর্যন্ত সবগুলো মেয়াদের কার্যনির্বাহী পরিষদের  প্র্রেসিডেন্ট, ভাইস- প্রেসিডেন্ট , সেক্রেটারিসহ অন্যান্য সদস্যদের পরিচয়, ছবিসহ নামের তালিকা, প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্যদের তালিকা, সংগঠনের ২৭ বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও অর্জন, যত বই প্রকাশ হয়েছে তা পিডিএফ আকারে সংরক্ষণ, সংগঠনের দুই যুগের কার্যক্রম নিয়ে একটা ডকুমেন্টারি তৈরি, সারা বছরের কর্মপরিকল্পনার সূচি ইত্যাদি।

হাজারো মাইল দূরে থেকেও তাঁরা বিশেষ আলোচনা সভায় সঙ্গে থাকুক ভার্চুয়ালি
শুধু একটু পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনলেই সংগঠনের যেকোনো মিটিং বা আলোচনা সভায় একই সময়ে ১২ হাজার ৮৪০ কিমি দূরে থাকা আমেরিকা বা লন্ডন বা প্রবাসী সম্মানিত সদস্যরা ভার্চুয়ালি যোগ দিতে পারেন। সভায় সদস্যদের উপস্থিতির পাশাপাশি মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরের সাহায্যে ভার্চুয়ালি প্রবাসী সদস্যরা মিটি বা বার্ষিক সাধারণ সভায় অংশগ্রহণ করতে পারবেন বলে আমি আশাবাদী।   

হৃদয় দিয়ে ধারণ করতে হয় সংগঠনকে
কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্যদের সংগঠনকে ধারণ করতে হয় হৃদয়ে। আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব গ্রহণ করে যখন কেউ মন থেকে বলতে পারেন, এই সংগঠনটা আমার। এটিকে তিন বছর আমি নিজের সন্তানের মতো যত্ম করবো। তখন তাঁর সব কাজগুলো হবে স্বতঃস্ফূর্ত, আত্মনিবেদিত। সদস্যদের কল্যাণমুখী। সেটি প্রকাশ পাবে সদস্যদের সঙ্গে তাঁর কথায়, কাজে, ব্যবহারে ও আচরণে। যারা নির্বাচিত হয়ে মনে করেন আমি জনগণের ভোটে নেতা হয়েছি। এটা আমার অর্জিত ক্ষমতা। এই তিনটা বছর আমি আমার মতো করে কাজ করবো। সাধারণত, এ মনোভাবের মানুষগুলো দ্বারা সংগঠন ও সদস্যদের কল্যাণমূলক তেমন কোনো কাজই হয় না। অন্যদিকে, এই শ্রেণির কেউ কেউ আবার সুকৌশলে সংগঠনকে ব্যক্তি স্বার্থ সিদ্ধি বা নিজের ব্যবসা বড় করার ব্যানার ও টুলস হিসেবে ব্যবহার করেন। আমাদের চারপাশে বিভিন্ন সংগঠনে এমন উদাহরণ অনেক রয়েছে। এমনটা কারোই কাম্য নয়।

বয়স তোমার ২৮, শুধু কি সংখ্যা, না যোগ্যতায়?
১৯৯৭ সালে রাজধানীর ফার্মগেটের তেজগাঁও কলেজের বিপরীতে পরিত্যাক্ত মাঠটি ছিল (আনোয়ারা উদ্যান), সেখানে খোলা আকাশের নিচে ভাসমান মানুষ বাস করতো। সময়ের পরিবর্তনে সেটির উপর দিয়ে মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে হয়ে গেছে। তাই সংগঠনের দৃশ্যমান কিছু ইনফ্রাস্ট্রাকচার ও পরিচালনা কৌশলও হতে হবে এমনই যুগোপযোগী ও স্মার্ট। কারণ সংগঠনটির বয়স এখন ২৮ বছর। একজন সচেতন লেখকের মনে প্রশ্ন আসতেই পারে ২৮ বছরের সংগঠনটি কি শুধু বয়সেই বড় হয়েছে, নাকি যোগ্যতা অর্জন করে পরিপক্কও হয়েছে। জানা মতে, সংগঠনটি এখনও সমাজসেবা অধিদফতর থেকে সরকারি নিবন্ধনের কাজ সম্পন্ন করা হয়নি।

২৮ বছরের যুবক যেমন নিজে সাবলম্বী হয়, তেমনিভাবে সংগঠনটিও সবদিক থেকে সাবলম্বী হওয়ার কথা। বাস্তবে কতটুকু হয়েছে সেটা ভাববার বিষয়। একটা সংগঠন তখনই সাবলম্বী বলা যাবে, যখন সংগঠনের গঠনতন্ত্র অনুসারে কার্যনির্বাহী পরিষদের সকল বিভাগের কার্যক্রমের সবকিছু তথ্য প্রমাণের সাথে সংরক্ষিত থাকে। আর্থিক লেন-দেনের বিষয়ে স্বচ্ছতা বজায় থাকে। প্রয়োজনীয় সব ফাইলপত্র, বিল-ভাউচার, ডকুমেন্টস গোছানো থাকে। শুধু সেকেলের মতো খাতায় লেখা নয়, এখন স্মার্টলি ওয়েবে ও সফটওয়্যারে সংরক্ষণ করাও সময়ের দাবি। এ বিষয়গুলো ঠিক থাকলে সংগঠন চলবে আপন গতিতে। সময়ের পালা-বদলে কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্যরা বদল হবে। কিন্তু সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালনার ইকোসিস্টেম ঠিকই থাকবে। সেই ইকোসিস্টেম কি গড়ে তোলা হয়েছে?

সংগঠনের গতিশীলতায় কৌশলগত কর্ম পরিকল্পনা
মানুষের কিছু সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে আবর্তিত হয় সংগঠনের কার্যক্রম। তাহলে বাংলাদেশ খ্রিস্টান লেখক ফোরামের কার্যক্রম কেমন হতে পারে? শুধু কি গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ লেখা, লেখক-কবিদের নিয়ে আড্ডার আসর, নতুন সদস্য পদ  দেওয়া, গুণীজন সম্মননা স্মারক, তিন মাসে বা ছয় মাসে একটা করে আর্শি প্রকাশ করার মধ্যে সীমাবদ্ধ?  অন্য পাঁচটা সংগঠনের মতো এসব গদ বাঁধা কার্যক্রমের বাইরেও করার আছে অনেক কিছু। 

স্মার্ট যুগে সংগঠনের গতিশীলতা বাড়াতে কৌশলগত পরিকল্পনায় আনতে হবে বৈচিত্রতা। যেখানে সব সদস্যরা সক্রিয়ভাবে সব কাজে অংশগ্রহণ করে নিজেদের প্রতিভাকে বিকশিত করতে পারেন।  এর জন্য বর্তমানে কার্যনির্বাহী পরিষদকে নিতে হবে সময়োপযোগী পদক্ষেপ ও কার্যকর উদ্যোগ। তৈরি করতে হবে তিন বছরের জন্য স্মার্ট কৌশলগত পরিকল্পনা, তিন বছরের রোডম্যাপ। চলতি ২০২৪-২০২৭ মেয়াদের কোন মাসে কি প্রোগ্রাম আয়োজন করা হবে, সেগুলো নিয়ে একটা ক্যালেন্ডার প্রকাশ করা যেতে পারে। এখন এগুলো তৈরি করবে কে? এসব রোডম্যাপ তৈরির জন্য সংগঠনে যারা এসব বিষয়ে দক্ষ ও অভিজ্ঞ তাদের নিয়ে একটা পরিকল্পনা প্রস্তুত-বিষয়ক কমিটি করা যেতে পারে।

সৃজনশীল কর্মযজ্ঞে সবার নিমন্ত্রণ
২০২৪-২০২৭ সাল মেয়াদের কার্যক্রমকে সফলভাবে বাস্তবায়নের জন্য বিষয়ভিত্তিক  উপ-কমিটি গঠন করা যেতে পারে। যাদের নেতৃত্বে অনুষ্ঠান বা আয়োজনগুলো সুন্দর হতে পারে। এসব কমিটির আহ্বায়ক থাকতে পারেন কার্যনির্বাহী পরিষদের সংশ্লিষ্ট সদস্যরা। যেমন, যারা গান-বাজনা পরিচালনা, উপস্থাপনা, আবৃত্তিতে দক্ষ, তাদের নিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিচালনা কমিটি, সম্পাদনায় দীর্ঘদিনের যাদের অভিজ্ঞতা রয়েছে, তাদের নিয়ে প্রকাশনা উপ-কমিটি, প্রবাসী লেখকদের সাথে যাদের সুসম্পর্ক রয়েছে তাদের নিয়ে আন্তর্জাতিক-বিষয়ক উপ-কমিটি,  যারা নিউজ লেখা-লেখি, গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস সম্পদনায় দক্ষ এবং ওয়েবসাইটে আপলোড করতে পারে, তাদের নিয়ে একটা ডিজিটাল মিডিয়া উপ-কমিটি করা যেতে পারে। উপ-কমিটি থাকলে সদস্যদের নিজস্ব প্রতিভা বিকাশের সুযোগ তৈরি হবে। অন্যদিকে সকলের স্বতঃস্ফূর্ত  অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে। প্রাণ ফিরে পাবে সংগঠন।  

সদস্যদের স্মার্ট স্বীকৃতি প্রদান
প্রত্যেক সদস্যকে লেখক হিসেবে পরিচয়ের স্বীকৃতি হিসেবে একটা স্মার্ট কার্ড বা পরিচয়পত্র দেওয়া যেতে পারে। স্মার্ট কার্ডটি সদস্যরা নির্বাচনে ভোট দেওয়ার সময় পরিচয়পত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন। দেশের বাইরে গেলেও কখনও কখনও সংগঠনের এসব পরিচয়পত্রের গুরুত্ব বিশেষভাবে ভূমিকা রাখে। এছাড়াও সংগঠনের পক্ষ থেকে আমাদের সব খ্রিস্টান হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডাক্তার, উকিল, স্কুল ও কলেজের সাথে সমঝোতা চুক্তি করা যেতে পারে। সদস্যরা যখন অসুস্থ হবেন তখন তাঁরা যেনো ওই স্মার্ট আইডি কার্ড দেখিয়ে চুক্তিকৃত ডাক্তারের চেম্বারে ও হাসপাতালে সুলভ ও সাশ্রয়ী মূল্যে চিকিৎসা নিতে পারেন। একইভাবে খ্রিস্টান উকিল ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সুবিধা নিতে পারেন।

স্মার্ট যুগে প্রয়োজন যুগোপযোগী ও গ্রহণযোগ্য গঠনতন্ত্র
১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ খ্রিস্টান লেখক ফোরামের যাত্রার শুরুতে প্রথম কার্যনির্বাহী পরিষদের তিনজন প্রতিষ্ঠাতা সম্মানিত সদস্য প্রথম গঠনতন্ত্র রচনা করেন। ২৮ বছরের যাত্রাপথে সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালনার সুবিধার্থে কিছু পরিবর্তন আনা হয়। কিন্তু যুগের প্রয়োজনে এটিকে আরও স্মার্ট, সময়োপযোগী ও সদস্যবান্ধব করা সময়ের দাবি। কেননা যেকোনো সংগঠন সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে পরিচালনার জন্য প্রয়োজন একটা মানসম্পন্ন, সময়োপযোগী, সদস্যবান্ধব এবং গ্রহণযোগ্য গঠনতন্ত্র। এই গঠনতন্ত্রের সাহায্যেই পরিচালিত হয় সংগঠনের প্রতিটি মেয়াদের সব সাংগঠনিক কার্যক্রম।

লেখকরা সৃজনশীল জগতে বিচরণ করেন
একজন লেখক বিভিন্ন গুণেগুণান্বিত হতে পারেন। একাধারে কবি, সাহিত্যিক, গল্পকার, প্রবন্ধকার, গবেষক, সাংবাদিক, নাট্যকার, নাট্য পরিচালক, অভিনেতা, উপস্থাপক, আবৃত্তিকার, সুবক্তা, গায়ক, বাদক ইত্যাদি। সবগুলোই সৃজনশীল কাজ। লেখালেখি হতে পারে তাঁর নেশা বা পেশা। এর বাইরেও তিনি এসব গুণের অধিকারী। এখন যদি বলা হয় যারা শুধু গল্প বা কবিতা ও প্রবন্ধ লিখেন, তারাই শুধু লেখক ফোরামের সদস্য হবেন। এর বাইরের সৃজনশীল কাজের সাথে যুক্ত ব্যক্তিরা সদস্য হতে পারবেন না। আমি মনে করি, এটা একটা গন্ডির মধ্যে সীমবদ্ধ হয়ে যাবে। গঠনতন্ত্রে যদি এই ধারাটা থাকে, তাহলে এটা পরিবর্তন করলে ভাল। 

যারা লেখালেখি করেন না বা কোনো ধরনের লেখাই লিখতে পারেন না, এমন ব্যক্তিকে সদস্য পদ দেওয়া হোক, সেই কথা বলছি না। যারা লেখালেখির সাথে যুক্ত আছেন তাদের কথা বলছি। আমি মনে করি, সারা দেশের আগ্রহী লেখকদের সংগঠনের গঠনতন্ত্র মেনেই তাদের সদস্য পদ দেওয়া যেতে পারে। যদি তাঁর মনে সদ্বিচ্ছা থাকে আর লেখার সাথে সম্পর্ক থাকে, সেটা কাজেই প্রকাশ পাবে। আর না থাকলে একটা সময় নিজেই কাজ না করার লজ্জায় পড়বেন। সংগঠনে থাকার যোগ্যতা হারাবেন। তাই যারা নতুন লেখক তাদের নিয়ে নেতিবাচকভাবে সমালোচনা না করে বরং আমাদের উৎসাহ, অনুপ্রেরণা দেওয়ার অনুশীলন প্রয়োজন। কেননা আজ আমরা আছি। কাল থাকবো না। তখন নতুনদেরই কলম যোদ্ধা হিসেবে মহান দায়িত্বটা নিতে হবে।

খ্রিস্টান কলমযোদ্ধা অল্প
দেশের খ্রিস্টান লেখকের সংখ্যায় খুবই কম। পেশাদার, অপেশাদার ও সম্প্রদায়ভিত্তিক এমন ১৬-১৭টি সংগঠনের কার্য়ক্রম কাছে থেকে দেখার অভিজ্ঞতা থেকে আমি মনে করি, সম্প্রদায়ভিত্তিক কলমযোদ্ধা হিসেবে আমাদের সংখ্যাটা আরও বাড়ানোর প্রয়োজন রয়েছে। কেন? সংখ্যায় বড় হলে এর প্রভাবটাও সারা দেশে পড়বে। বিশেষ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হিসেবে যেসব সমস্যা সৃষ্টি হয়, তখন ফোরামের ব্যানারে রাষ্ট্রীয়ভাবে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া সহজ হবে। প্রতিবাদ সভা-সমাবেশ করলে সেটা মিডিয়াতে আসবে। রাষ্ট্রীয়ভাবে দায়িত্বশীলদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা সহজ হবে। পেশাদার, অপেশাদার ওইসব সংগঠনে  ১ হাজার, ২ হাজার, ২ হাজার ৫০০ জন সদস্য। সেখানে আমাদের সারা দেশে ৩০০ থেকে ৩৫০ জন সদস্য হলে সমস্যা কোথায়? যারা প্রকৃত লেখক ও যোগ্য তারাই শুধু এ সংগঠনে যুক্ত হতে পারবেন। সারা দেশের সব ধর্মপ্রদেশে লেখকদের তৈরি করা এবং সাংগঠনিকভাবে তাদের নতুন সদস্যপদ দেওয়া এই কার্যনির্বাহী পরিষদের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে থাকছে।

লেখক হবেন মুক্ত চিন্তার অধিকারী
একজন লেখকের অন্যতম মানবিক গুণ হলো ইতিবাচক মনোভাবসম্পন্ন ও মুক্ত চিন্তার অধিকারী। ভাল-মন্দ, আলোচনা-সমালোচনা সব কিছুকে গ্রহণ করার মানসিকতাসম্পন্ন। মতের অমিল হলেও ছোট-বড়, ভাল-মন্দ সব শ্রেণি-পেশার মানুষের সাথে মিলে-মিশে একসাথে কাজ করতে সক্ষম তিনি। লেখকদেরর এমন বড় ও উদার মানসিকতা না থাকলে একটা সময় যেকোনো সংগঠনেরই নৈতিক সৌন্দর্য বিলীন হয়ে যায়। স্থান পায় চেয়ার দখলের স্নায়ুবিক ও মানসিক লড়াই। যখন কোন লেখক একজন ছোট লেখককেও তার প্রাপ্য সম্মানটুকু দিতে পারেন না, তখন ওই লেখক যত বড় মাপের লেখকই হন না কেন, ধীরে ধীরে মানুষের মন থেকে উঠে যান। হৃদয়ের মণিকোঠায় স্থান করে নেওয়া প্রিয় লেখকও হয়ে যান অপ্রিয় দলের।

সৃজনশীল লেখক আপন ভুবনের বাসিন্দা
একজন সুশীল, প্রগতিশীল, সচেতন ও সৃজনশীল লেখক কখনও অন্যের ক্ষতির করে না। তিনি তার নিত্যদিনের সৃজনশীল চিন্তায় ডুবে থাকতে পছন্দ করেন। কে ছোট বা বড় লেখক, কে মৌসুমি লেখক, কে  নিয়মিত লিখছেন, কে নিয়মিত লিখছেন না, সেদিকে তাঁর তাকানোর সময় কম থাকে। যারা প্রকৃত অর্থে সৃজনশীল কাজের মানুষ তারা অন্যের ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে গবেষণা করে না।  গুণী লেখকরা অন্যের লেখার মান, শব্দ চয়ন, বিষয় প্রকাশ ভঙ্গি, উপস্থাপনার ধরণ, কৌশল, এসব নিয়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে থাকেন। তাঁরা লেখার ইতিবাচক দিকগুলোর প্রসংশা করেন। দুর্বল দিকগুলো উত্তরণের পথ দেখান। 

নিতে হবে নতুন চ্যালেঞ্জ
২৮ বছরের পথচলায় সংগঠনের ইতিহাসে এবারই প্রথম ব্যালট পেপারে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।নির্বাচনটি সুষ্ঠু, সুন্দর, শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর পরিবেশে সম্পন্ন হয়েছে। দায়িত্ব পেলেন নতুন কার্যনির্বাহী পরিষদ। সময়ের সাথে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে নতুন কার্যনির্বাহী পরিষদকে নিতে হবে নতুন চ্যালেঞ্জ।

ভাবনার ফানুস পুড়ে প্রতিহিংসার আগুনে
একজন লেখক হিসেবে মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নেওয়াটা সুভাগ্যের বিষয়। ভাল লেখক হয়েও অনেকে তার সৃষ্ট সৃজনশীল সাহিত্যকর্ম দিয়ে মানুষের হৃদয় ছুঁতে পারেন না। কারণ তিনি তাঁর কথা-বার্তা, আচরণ ও চিন্তা-ভাবনায় পরিপক্কতার পরিচয় দিতে পারেন না। বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায়, বিশেষ করে হোয়াটসঅ্যাপে, ম্যাসেঞ্জারে পাবলিক গ্রুপে কোথায়, কিভাবে, কতটুকু প্রক্রিয়া প্রকাশ করতে হয়, আলাপে কেমন শব্দ চয়ন করতে হয়, সেক্ষেত্রেও বিচক্ষণতার অভাব রয়েছে। প্রত্যেকজন ব্যক্তি বা লেখক সম্মানিত। সবাই সম্মান চান।

সম্মানের বদলে তাঁকে নিয়ে অশালীন শব্দে সমালোচনা করলে, একজন ব্যক্তি মানুষ হিসেবে তিনি যখন সেগুলো দেখেন, পড়েন, তখন অসম্মানিতবোধ করবেন। মনে কষ্ট পাবেন। এমন অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ করলে ওই লেখক যত বিখ্যাত, প্রসিদ্ধ ও গুণীই হন না কেনো, একটা সময় তাঁর প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা কমতে থাকে। অন্যদিকে, ওই খ্যাতিমান লেখক হয় তো মনে মনে নিজেকে সবার থেকে বড় ভাবছেন। ছোটদের গোনার মধ্যেই ধরছেন না। তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করছেন। একটা সময় যখন প্রিয় মানুষগুলো তাঁকে এড়িয়ে চলতে থাকেন, তখন নিজে থেকেই মানসিক যন্ত্রণার আগুনে পুড়তে থাকেন। এমন আচরণ বিভিন্ন সংগঠনে লক্ষ্য করেছি। খ্রিস্টান হিসেবে আমাদের মধ্যে যে শিক্ষা ও মূল্যবোধ রয়েছে, এমন আচরণ কারওই কাম্য না।

এ চেয়ারটা আমার, আর কারও না
জনপ্রিয় লেখক বা কবি হলেই যে একজন ভাল ও সুদক্ষ নেতা হবেন, আসলে বিষয়টা তা নয়। লেখালেখির প্রতিভা ও দক্ষতা যেমন ঈশ্বরের দেওয়া ঐশ্বরিক ক্ষমতা, ঠিক তেমনি নেতৃত্বের বিষয়টাও একই। সবাই ভাল নেতা হতে পারেন না বা নেতৃত্ব দিতেও পারেন না। তাই বলে আমিই নেতৃত্বে সেরা। আমিই ভাল নেতৃত্ব দিতে পারবো, অন্যরা পারবেন না, এমন চিন্তা করাটা ভুল। আর কার ভেতরে কোন বিশেষ দক্ষতা বা প্রতিভা আছে, সেটাও অনেক সময় আমরা জানি না। যেকোনো অলাভজনক সংগঠনে নেতৃত্ব দেওয়া মানে, নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর শামিল। তাই এখানে যারা আসতে চায় তাদের সম্মান ও সাধুবাদ জানানো দরকার। কেননা, এই মানুষগুলো তাদের পেশাদারিত্বের কাজের বাইরে এসেও মূল্যবান সময় ব্যয় করে মানুষের কল্যাণে কাজ করতে আগ্রহ প্র্রকাশ করছেন। এটা অনেক বড় মানসিকতার পরিচয়। 

যখন কেউ বা কোন সিন্ডিকেট কোনো ব্যক্তির এই মহান উদ্দশ্য বাস্তবায়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তখন ধরে নিতে হবে তার মধ্যে অসৎ কোন উদ্দেশ্য রয়েছে। আমি পেশাদার ও অপেশাদার সংগঠনগুলোর সাথে যুক্ত হওয়ার অভিজ্ঞতায় দেখেছি যে ব্যক্তি বা একটা দল এভাবে নির্বাচনে যাদের ইমেজ পরিষ্কার, যারা সংগঠনের কল্যাণে কাজ করতে যোগ্য, স্বচ্ছতা, জবাবদিহীতার সাথে কাজ করতে আগ্রহী তাদের প্রার্থীতা বাতিল করার জন্য নানান ধরনের কৌশল অবলম্বন করেন। প্রার্থীর অফিসে গিয়ে পর্যন্ত নানা ধরনের অভিযোগ করে প্রার্থীকে চাকরিচ্যুত করার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে উঠেন। নির্বাচনের পর ওই ষড়যন্ত্রকারী ব্যক্তির বেরিয়ে আসে নানা অপকর্মের ইতিহাস। এমন জঘন্য মানসিকতা আমাদের মধ্যে কখনও না আসুক সেটাই আমাদের সবার কাম্য।

শেষ কথা
একটা নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের মানুষের যে কথাগুলো এককভাবে বললে রাষ্ট্রীয়ভাবে গুরুত্ব পায় না, সেটি সংগঠনের ব্যানারে বিশেষভাবে গুরুত্ব বহন করে। ওই সম্প্রদায়ের অধিকার আদায় সহজ হয়। আমাদের প্রাণের সংগঠন ‘খ্রিস্টান লেখক ফোরাম’ও একইভাবে গোটা খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের জাতীয় অধিকার আদায়ে সুদূরপ্রসারী ও বিলষ্ঠ ভূমিকা রাখবে। এমনটাই প্রত্যাশিত। (লেখাটি খ্রিস্টান লেখক ফোরামের লিটল ম্যাগাজিন আর্শির ডিসেম্বর সংখ্যায় সংক্ষেপে প্রকাশিত হয়েছে)

লেখক: উজ্জ্বল এ গমেজ, লেখক ও সাংবাদিক।
image

আপনার মতামত দিন