মাত্র ৫০ টাকায় থাকা যাবে বুড়িগঙ্গার ভাসমান বোর্ডিংয়ে

প্রকাশ: শনিবার, ০২ অগাস্ট, ২০২৫
https://mail.techvoice24.com/assets/images/logoIcon/logo.png টেকভয়েস২৪  ডেস্ক
https://mail.techvoice24.com/assets/images/logoIcon/logo.png
  ছবি: সংগৃহীত

নগর পত্তনের চিহ্ন থাকে নদীর কাছে। পূতি গন্ধময়, কালো পানির বুড়িগঙ্গার বাঁকে এমন এক ইতিহাসের গল্প হচ্ছে ‘ভাসমান বোর্ডিং’। বাংলাদেশে ভাসমান বোর্ডিং ব্যবসার বয়স এখন ৫৯ বছর। বারো মাস পানির ওপর ভেসে থাকা লঞ্চ আকৃতির এই বোর্ডিংয়ে ঠাঁই পান নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী, বিপদাপন্ন অথবা অভিমানে একা হওয়া মানুষেরা।

জনপ্রতি দিনের খরচ ৫০ থেকে ১৫০ টাকা। রাজধানীর মিটফোর্ড ঘাটে বর্তমানে আছে এমন চারটি বোর্ডিং। আরেকটি পরিত্যক্ত হয়ে আটকে আছে বুড়িগঙ্গার শুকনো পাড়ে। এসব বোর্ডিংয়ে উঠতে হয় শহর রক্ষা বাঁধ থেকে অনেকটা ঢালুতে নেমে, বাঁশের সাঁকো ধরে।

বুড়িগঙ্গা বোর্ডিংয়ের ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ মোস্তফা বললেন, ভাসমান বোর্ডিংয়ের বাসিন্দাদের জীবন চলে ঘাটে লঞ্চ ভেড়ার সময়সীমার সঙ্গে মিলিয়ে। অধিকাংশই ভ্রাম্যমাণ ফল বিক্রেতা ও হকার। তবে দূর থেকে মিটফোর্ড হাসপাতালে রোগী নিয়ে আসা সংগতিহীন স্বজনেরাও আসেন থাকতে। গত শতকের ষাটের দশকে লালকুঠির শ্যামবাজার ঘাটে শুরু হওয়া এই ব্যবসা সময়ে সময়ে ঠাঁই পেয়েছে বুড়িগঙ্গার ভিন্ন ভিন্ন ঘাটে।

কারা থাকেন, কত খরচ
বাঁধের সরু জায়গায় দাঁড়িয়ে মনে হবে যেকোনো সময় হুইসেল বাজিয়ে লঞ্চ ছেড়ে দেবে। আদতে এটা স্থির কাঠামো। লঞ্চের মতো এ জায়গায় ভাড়াটে বাসিন্দারা দোতলার খোলা ছাদে দড়ি টাঙিয়ে জামাকাপড় শুকাতে দিয়েছেন। তবে বোর্ডিংয়ে উঠে ভেতরে পা বাড়ালেই চেপে ধরবে অন্ধকার। লম্বা সরুমতো একটা পথ যাতায়াতের। দুপাশ দিয়ে ছোট ছোট ঘরের দরজা। এসব ঘরই কেবিন, যার ভাড়া ১২০ থেকে ১৫০ টাকা করে।

মাথা নিচু করে সেসব দরজা দিয়ে প্রবেশ করতেই বিছানা শুরু। ঘরের সীমানাও শেষ তোশকের শেষ কোনায়। মাথার ওপর একটা বাল্ব জ্বলে যেন অন্ধকারকে আরও ডেকে আনছে। আছে মুঠোফোন চার্জ দেওয়ার ব্যবস্থা। সিলিং ফ্যানের ভাবনা দূরস্থান। তবে শীতকালে দরকারও হয় না। এখানে ঢালাই বিছানাতেও থাকার ব্যবস্থা আছে। সেখানে খরচ ৫০ টাকা করে। এত কম মূল্যে ঢাকা শহরের আর কোথাও থাকার ব্যবস্থা সম্ভবত নেই। প্রতিটি লঞ্চে ৫০ থেকে ৬০ জন করে থাকার ব্যবস্থা আছে।

বর্তমানে বুড়িগঙ্গার কচুরিপানার ভেতর দাঁড়িয়ে থাকা শরীয়তপুর মুসলিম বোর্ডিং, বুড়িগঙ্গা বোর্ডিং, ফরিদপুর মুসলিম বোর্ডিং ও সাবেক উমা-উজালা মিলিয়ে শ দেড়েক বোর্ডার থাকেন। তাঁদের বেশির ভাগই সদরঘাটে ফল বিক্রেতা। এর মধ্যে শরীয়তপুরের জাজিরার আবদুল হাকিমকে একটু আলাদাভাবে চোখে পড়ে তাঁর সাদা পোশাকের জন্য। ষাটোর্ধ্ব আবদুল হাকিম ৪০ বছর ধরে ভাসমান ফরিদপুর মুসলিম বোর্ডিংয়ের বাসিন্দা। কালেভদ্রে বাড়িতে যান। চার দশক ধরে এভাবে থাকতে থাকতে তাঁর অভ্যাস হয়ে গেছে বলে জানালেন। একসময় দিনে ২০ টাকা করেও থেকেছেন।

ফরিদপুর মুসলিম বোর্ডিংয়ের পাশে সর্বশেষ বোর্ডিংয়ের আপাতত কোনো নাম নেই। আগের নাম ছিল উমা-উজালা। নতুন নামকরণ হবে। শব্দ পেয়ে সেখান থেকে উঁকি দিলেন এখানকার কর্মচারী মো. নাজিম খলিফা। পটুয়াখালীর বাউফলের এই বাসিন্দা জানালেন, বুড়িগঙ্গায় চৈত্র মাসে জোয়ার-ভাটা একেবারেই থাকে না। তখন শৌচাগারে ব্যবহারের পানিতেও ফিটকিরি দিতে হয়। অন্য সময় সবাই ১০ টাকা দিয়ে গোসল করেন ঘাটে কাছের মসজিদে। খাওয়ার পানি দেওয়া হয় বোর্ডিং থেকে। নাজিম খলিফা এক দশকের বেশি সময় ধরে দেখাশোনা করছেন তাঁর মালিকের বোর্ডিং।

এই বোর্ডিংগুলোতে এখন ভাত খাওয়ার ব্যবস্থা নেই। রান্নার জায়গাই নেই। বোর্ডাররা মিটফোর্ড ঘাটের হোটেলে খেতে যান। তবে টিফিন বাটির ব্যবস্থা আছে। বাটিতে করে খাবার আসে কেরানীগঞ্জ থেকে, নৌকায়। জনপ্রতি ৭০ টাকা বাটি। কিন্তু এই মূল্য ভাসমান বাসিন্দাদের জন্য অনেক বেশি বলে জানালেন শরীয়তপুর মুসলিম বোর্ডের মালিক আবদুস সাত্তারের ছেলে মাহমুদ উল্লাহ। তাঁর দেওয়া তথ্যমতে, এখানকার অধিকাংশ নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী মানুষ খাওয়ার জন্য বোর্ডিংয়ে ফিরে আসার সময় পান না। তাঁরা সদরঘাট থেকে লঞ্চ আসা-যাওয়ার সময় ফল বিক্রি করতে যান। তাঁরা প্রতি বেলার খাবার ৫০ টাকার মধ্যে শেষ করেন। না হলে ঘরভাড়া দিয়ে দিনপ্রতি খরচ দাঁড়ায় অন্তত ২০০ টাকায়।

মাহমুদ উল্লাহ জানালেন, এই বোর্ডিংগুলোর জন্য বছরে আট থেকে দশ হাজার টাকা করে নবায়ন ফি দিতে হয় বিআইডব্লিউটিএকে (অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন)। এই নবায়ন ফি নির্ধারিত হয় বোর্ডিংয়ের আকার অনুযায়ী। বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করেন বোর্ডিং মালিকেরা। এখন প্রিপেইড মিটারে চলে।

বুড়িগঙ্গা বোর্ডিংয়ে দেখা হলো মো. জামাল হোসেনের সঙ্গে। তিন যুগ ধরে সৌদিপ্রবাসী জামাল হোসেন দেশে ফিরেছিলেন অনেক প্রত্যাশা নিয়ে। পরিবারের কাছ থেকে পেয়েছেন প্রতারণা। অভিমানে স্বেচ্ছানির্বাসনে এসেছেন এখানকার কেবিনে। এখান থেকেই ফিরে যাবেন আবার প্রবাসজীবনে। আর কখনো ফিরবেন না বলে জানালেন। জামাল হোসেনের কষ্টের কথা বুড়িগঙ্গার বাতাসে ভেসে বেড়াবে কি না জানি না। তবে এই ভাসমান বোর্ডিংগুলোর বদলে যাওয়ার কথা লেখা প্রয়োজন। এখনো পুরান ঢাকার মানুষের মুখে মুখে আছে এর কিছু কিছু স্মৃতিকথা।

ভাতের সঙ্গে ঘুমের সম্পর্ক গলায়-গলায়। ভাতঘুমের সেই সূত্র ধরেই তখন বুড়িগঙ্গার ভাতের হোটেলে বেশি খেয়ে একটু গড়িয়ে নিতে চাইতেন দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা মানুষ অথবা বুড়িগঙ্গাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বাণিজ্যিক জনপদের মানুষেরা। এই নদীর পারেই রয়েছে বলধা গার্ডেন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, আহসান মঞ্জিলসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। কলতাবাজারের বিখ্যাত ঘুড়িওয়ালা হাসমত আলী আর প্যারীদাস লেনের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী নয়ন ভৌমিক দুজনেরই মনে আছে পাকিস্তান আমলে ওয়াইজঘাট, বাদামতলী আর শ্যামবাজার ঘাটে ভাতের হোটেলের কথা।

হাসমত আলী বলেন, ‘পাকিস্তান আমলের কথা। তখন সব বড় বড় তরকারির নৌকা আসত শ্যামবাজারে। ভাতের হোটেল ছিল। ওয়াইজঘাট, বাদামতলী ঘাটেও একই রকম দোকান বসে। তখনো থাকার ব্যবস্থা হয় নাই। তবে হোটেল আরও বেশি ছিল।’

প্যারীদাস লেনের সত্তরোর্ধ্ব নয়ন ভৌমিক বললেন, তখন ভাত বিক্রি হতো পাল্লায় কেজি হিসাবে। মানুষ শুধু ভাত খেতে চাইত। মূলত ঘাটকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা শ্রমজীবী মানুষ, দক্ষিণাঞ্চল থেকে নদীপথে আসা মানুষের জন্য ছিল এ ব্যবস্থা। বেশি ক্লান্ত হলে কেউ কেউ তখন খেয়ে আশপাশেই ঘুমিয়ে যেত। সেখান থেকে শুরু হয় ভাসমান বোর্ডিং ব্যবস্থা। এই বোর্ডিংগুলো শ্যামবাজার থেকে শুরু করে, সদরঘাট হয়ে ওয়াইজঘাট আর বাদামতলী ঘাট ঘুরে কয়েক বছর ধরে দাঁড়িয়েছে মিটফোর্ড ঘাটে। একসময় দশটির মতো ভাসমান বোর্ডিং ছিল বলে শোনা যায়। এখন এ সংখ্যা ৪। এই বোর্ডিংয়ে যেমন অল্প আয়ের মানুষের আশ্রয় আছে, তেমনি এর সঙ্গে মিশে রয়েছে বুড়িগঙ্গা ধরে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের যাতায়াতকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা মানুষের সংস্কৃতির ইতিহাসও। সূত্র: প্রথম আলো

image

আপনার মতামত দিন