স্বপ্নের বাড়ি-সুন্দর, আরামদায়ক পরিবেশে রুচিসম্মত একটি ঘর কে না চায়? বাসস্থান মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোর একটি, আর তাই এটি সবার কাছেই অত্যন্ত কাঙ্ক্ষিত। তবে অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতার কারণে অনেকের সেই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ পায় না। সম্পদের সীমাবদ্ধতা চিরন্তন বাস্তবতা হলেও, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয় গড়ে তোলার আকাঙ্ক্ষা মানুষকে বারবার স্বপ্ন দেখায়।
এই স্বপ্ন বাস্তবায়নে ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা নিতে গেলে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মাথায় রাখা জরুরি। যেমন-সাইটের উপযুক্ততা, স্থাপত্য নকশা, কাঠামোগত ডিজাইন, সরকারি-বেসরকারি নির্দেশিকা (বিনির্দেশিকা) এবং রেট শিডিউল বা বাজারদরের ভিত্তিতে সম্ভাব্য খরচের প্রাথমিক ধারণা।
সঠিক পরিকল্পনা ও বাজেট প্রণয়নের জন্য নির্মাণের পূর্বেই এসব বিষয়ে পর্যাপ্ত ধারণা নেওয়া অপরিহার্য। এতে যেমন খরচের সঠিক মূল্যায়ন করা সম্ভব হয়, তেমনি নির্মাণপ্রক্রিয়াও হয় দক্ষ, সাশ্রয়ী ও সময়োপযোগী।
সাধারণভাবে প্রকৌশলকাজের এই সম্ভাব্য ব্যয় বা খরচ নির্ণয়ের পদ্ধতিকে প্রাক্কলন বা এস্টিমেট বলে। প্রাক্কলন হলো একটি প্রকল্পে (ভবন নির্মাণ, রাস্তা তৈরি, ব্রিজ নির্মাণ ইত্যাদি) সম্ভাব্য ব্যয়, সময়, শ্রম ও উপকরণের পরিমাণ আগেভাগে হিসাব করে বের করার পদ্ধতি, যার ইংরেজি শব্দ এস্টিমেশন।
প্রাক্কলনের উদ্দেশ্য হলো কোনো নির্মাণকাজে ব্যয়ের সম্ভাব্য ধারণা পাওয়া, বাজেট তৈরি, দাপ্তরিক ক্ষেত্রে টেন্ডার ডকুমেন্ট তৈরি, প্রকল্প পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি, নির্মাণ উপকরণ, যন্ত্রপাতি সংগ্রহ, অর্থ সংগ্রহের প্রস্তুতি এবং প্রকল্প বাস্তবায়ন শেষে বা নির্মাণোত্তর খরচ যাচাই করে আসল ব্যয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া। নির্মাণকাজে কাঠামোর প্রয়োজনীয় বিভিন্ন অঙ্গের পরিমাণ নিরূপণ করে বাজারদরে বা নির্ধারিত রেট শিডিউল অনুসারে প্রাক্কলন প্রস্তুত করা হয়। প্রাক্কলনের জন্য প্রয়োজন বিস্তারিত স্থাপত্যনকশা, কাঠামোগত ডিজাইন, বিনির্দেশিকা ও বিভিন্ন আইটেমভিত্তিক সমসাময়িক দর।
প্রাক্কলনের যথার্থতা নির্ভর করে ভিত বা ফাউন্ডেশন প্রভিশন, স্থাপত্য ও কাঠামোগত নকশা, নির্মাণসামগ্রীর মূল্য, নির্মাণ মান (স্ট্যান্ডার্ড) এবং ব্যবহৃত ফিটিংস ও ফিক্সিংয়ের তুলনামূলক বাজারদর। নির্মাণকাজে টেকসই ও গুণগত মানসম্পন্ন সামগ্রী ব্যবহার করা উচিত। এ বিবেচনায় বেশি মূল্যমানের নির্মাণসামগ্রী তথা ফিটিংস ও ফিক্সিং ব্যবহার করা হলে ব্যয় প্রাক্কলন অনেকাংশে বেড়ে যায়। এককথায়, কোনো ক্রয়কার্যে প্রাক্কলন একটি আপেক্ষিক বিশ্লেষণ ও সম্ভাব্য ব্যয়ের হিসাব, যা নির্দিষ্ট পরিমাণ পানিতে রং মেশানোর মতো। মিশ্রণে রঙের পরিমাণ যত বেশি হবে, এটি তত গাঢ় ও উজ্জ্বল হবে। অর্থাৎ যত গুড় তত মিঠা।
এ ছাড়া ফাউন্ডেশনভেদে ভবনের নির্মাণ খরচের বড়ই তারতম্য হয়। যেমন মাটির ভার বহন ক্ষমতা যদি যথেষ্ট ভালো হয়, পাইল ফাউন্ডেশন না দিয়েও শ্যালো ফাউন্ডেশনে তথা অগভীর ভিতে ভবন নির্মাণ করা সম্ভব। এ ফাউন্ডেশন প্রভিশনে নির্মাণ ব্যয় অপেক্ষাকৃত কম হয়। অগভীর বা শ্যালো ফাউন্ডেশনে প্লিন্থ এরিয়াভিত্তিক প্রতি বর্গফুটে সম্ভাব্য ব্যয় ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার টাকা হতে পারে। তদনুযায়ী, ৫ তলা ভিতবিশিষ্ট ১ হাজার ২০০ বর্গফুট আয়তনের প্লিন্থ এরিয়াবিশিষ্ট ভবনের সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ ব্যয় হবে যথাক্রমে প্রায় ১ কোটি ১০ ও ১ কোটি ২০ লাখ টাকা।
অপর পক্ষে, নির্মিতব্য ইমারত বা ভবনের সাইটে যদি মাটি দুর্বল হয় বা এর ভার বহন ক্ষমতা কাঙ্ক্ষিত না হয়, সে ক্ষেত্রে পাইল ফাউন্ডেশনের প্রয়োজন হবে, যা ব্যয়বহুল এবং সময়সাপেক্ষ। এ অবস্থায় ইমারত বা ভবনের খরচ প্লিন্থ এরিয়াভিত্তিক প্রতি বর্গফুটের ব্যয় প্রাক্কলন হবে ২ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার টাকা। এ ক্ষেত্রে একই ভিতবিশিষ্ট সম আয়তনের ভবন নির্মাণে ওই দরে (ভ্যাট আইটি ও ঠিকাদারি লাভ ব্যতিরেকে) আনুমানিক সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ ব্যয় হবে যথাক্রমে প্রায় ১.৫০ কোটি ও প্রায় ১.৮০ কোটি টাকা।
ঢাকা বা ঢাকার আশপাশের এলাকায় একটি নির্মিতব্য ১০ তলা ভিতবিশিষ্ট ১২ হাজার বর্গফুট প্লিন্থ এরিয়া সম্পন্ন মাঝারি মানের ভবন নির্মাণে প্রতি বর্গফুটে সম্ভাব্য খরচের ফিরিস্তি তুলে ধরা যেতে পারে। যাতে ভবনের নকশা অনুসারে সিভিল, ইলেকট্রিক্যাল, পানি সরবরাহব্যবস্থা, ফায়ার ফাইটিং প্রটেকশন, ডিটেকশনসহ ইলেকট্রোমেকানিক্যাল ইত্যাদি অঙ্গের পৃথক খরচের সমন্বয়ে সার্বিক ব্যয় প্রাক্কলন বা এস্টিমেট প্রস্তুত করার প্রয়োজন হয়।
প্রকৃতপক্ষে, ভবন বা ইমারতের ব্যয় প্রাক্কলন বিভিন্ন বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। যেমন সংশ্লিষ্ট সাইটের মাটির ভার বহন ক্ষমতা, স্থাপত্যনকশা, কাঠামোগত ডিজাইন, নির্মাণসামগ্রীর বাজারদর, বিভিন্ন ধরনের ও দরের ফিটিংস ও ফিক্সিং, শ্রমিক মজুরি ও অন্যান্য খরচ। বহুতল ভবন ও মাটির ভারবহন ক্ষমতা অপেক্ষাকৃত কম বিবেচনায় পাইল ফাউন্ডেশনে ১০ তলা ভিতবিশিষ্ট ১২ হাজার বর্গফুট প্লিন্থ এরিয়াভিত্তিক ভবনের (ভ্যাট আইটি ও ঠিকাদারি লাভ ব্যতিরেকে) সম্ভাব্য সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ নির্মাণ খরচ হতে পারে যথাক্রমে প্রায় ৩০ কোটি ও ৩৬ কোটি টাকা।
সাইটে মাটির অবস্থা ভালো হলে এমন ১০ তলা বা বহুতলবিশিষ্ট ভবনও অভিজ্ঞ পুরকৌশলী দিয়ে কাঠামো ডিজাইনারের পরামর্শক্রমে শ্যালো ফাউন্ডশন বা অগভীর ভিতেও নির্মাণকাজ সম্পন্ন করা যায়। সে ক্ষেত্রে বাস্তবায়নে সময় কম লাগে এবং নির্মাণ খরচ অপেক্ষাকৃত আরও কম লাগে। ভবন বা ইমারত নির্মাণে প্রদত্ত ব্যয় একটি প্রাথমিক ও আনুমানিক ধারণা, যা প্রতিটি নির্মাণকারী তথা নির্মিতব্য ভবনমালিকের পরিকল্পনা গ্রহণ, বাস্তবায়ন, অর্থের জোগান এবং সামর্থ্য বিবেচনার বিষয়টি নিশ্চিত করতে সহায়ক হয়।
অপরিকল্পিত ভবন নকশা এবং প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত নকশার (ওভার ডিজাইন) কারণেও ভবন নির্মাণের ব্যয় বেড়ে যায়। ভবন বা ইমারত নির্মাণে সৌন্দর্যপ্রিয়তা, ফিটিং ও ফিক্সিং এবং নির্মাণসামগ্রীর দরের তারতম্যভেদে ব্যয় প্রাক্কলনও হেরফের হতে পারে। নিরাপদ, পরিবেশসম্মত, নান্দনিক এবং স্বল্প ব্যয় তথা যথাযথ ব্যয়ে ভবন নির্মাণ করতে হলে অবশ্যই স্বনামধন্য স্থপতি ও অভিজ্ঞ পুরকৌশলীর মাধ্যমে যথাক্রমে স্থাপত্য নকশা প্রণয়ন ও কাঠামোগত নকশা সম্পন্ন করে ব্যয়ের প্রাথমিক ধারণা বা প্রাক্কলন প্রস্তুত করা উচিত।
লেখক: মো. আব্দুল আজিজ, প্রধান প্রকৌশলী, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন, ই-মেইল: ce@ncc.gov.bd