পিএইচডির ছাত্র মানবাকৃতির রোবট 

প্রকাশ: রবিবার, ০৩ অগাস্ট, ২০২৫
https://mail.techvoice24.com/assets/images/logoIcon/logo.png টেকভয়েস২৪  ডেস্ক
https://mail.techvoice24.com/assets/images/logoIcon/logo.png
  ছবি: সংগৃহীত

চীনের উচ্চশিক্ষা ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা গবেষণায় নতুন এক মাইলফলক স্পর্শ করল দেশটি। ইতিহাসে প্রথমবার, একটি হিম্যানয়েড রোবটকে পিএইচডি প্রোগ্রামে ভর্তি করা হয়েছে। ‘শুয়েবা ০১’ নামের এই রোবট ইতোমধ্যেই সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। কেউ একে প্রযুক্তির সম্ভাব্য ভবিষ্যত হিসেবে দেখছেন, আবার অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, একটি যন্ত্র কি আদৌ মানবিক আবেগ ও শিল্পচর্চাকে হৃদয়ে ধারণ করতে পারে?

কে এই শুয়েবা ০১?
শুয়েবা ০১ হলো একটি মানবাকৃতির রোবট। এটি যৌথভাবে তৈরি করেছে ইউনিভার্সিটি অব শাংঘাই ফর সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি এবং ড্রয়িডআপ রোবটিকস। ‘শুয়েবা’ শব্দটি চীনা তরুণদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয়। যারা পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর পায় এবং জ্ঞানে অগ্রগামী এমন মেধাবী ছাত্রছাত্রী বোঝাতে ব্যবহৃত হয় এটি।

এই রোবট শুধু প্রযুক্তির জগতে নয়, শারীরিক সক্ষমতার দিক থেকেও দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। শুয়েবা ০১ পূর্বে বিশ্বের প্রথম হিম্যানয়েড হিসেবে একটি হাফ-ম্যারাথন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে তৃতীয় স্থান অর্জন করে।

শারীরিক ও ভাষাগত গুণাবলি
শুয়েবা ০১-এর উচ্চতা ১.৭৫ মিটার এবং ওজন মাত্র ৩০ কেজি। সুসজ্জিত মুখমণ্ডলে সিলিকন দিয়ে তৈরি ত্বক এবং চশমাসহ পরিপাটি পোশাকে তাকে একজন বাস্তব মানুষের মতোই মনে হয়। এটি সাবলীলভাবে মান্দারিন ভাষায় কথা বলতে পারে এবং মানুষের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে যোগাযোগ করতে সক্ষম।

পিএইচডির গবেষণার বিষয়
২০২৫ সালের ২৭ জুলাই, ওয়ার্ল্ড আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স কনফারেন্সে শাংঘাই থিয়েটার একাডেমি (এসটিএ) আনুষ্ঠানিকভাবে শুয়েবা ০১-কে নাট্যকলা ও চলচ্চিত্র বিভাগের পিএইচডি প্রোগ্রামে ভর্তি করে। তার গবেষণার মূল বিষয়: চীনের ঐতিহ্যবাহী অপেরা। ১৪ সেপ্টেম্বর থেকে সে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্লাসে অংশ নেবে এবং চার বছরের মধ্যে একটি গবেষণাপত্রও জমা দেবে।

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, রোবটটি চিত্রনাট্য, অভিনয়, মঞ্চসজ্জা ছাড়াও প্রযুক্তিনির্ভর বিষয় যেমন মোশন কন্ট্রোল, ভাষা উৎপাদন ইত্যাদিও পড়বে।

শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে ‘শিক্ষার্থী’ রোবট
শুয়েবা ০১-এর একাডেমিক তত্ত্বাবধানে রয়েছেন খ্যাতিমান শিল্পী ও অধ্যাপক ইয়াং ছিংছিং। অধ্যাপক ইয়াং জানান, ‘এই রোবট কেবল অভিনয়ের অনুশীলনই করছে না, বরং সহপাঠীদের সঙ্গে ইন্টারঅ্যাকশন করে, শিল্পচর্চায় অংশ নেয় এবং কৃত্রিম ও প্রাকৃতিক সৃজনশীলতার মধ্যে এক নতুন সেতুবন্ধন গড়ে তোলে।’

তিনি আরও বলেন, “যখন শুয়েবা ০১ অপেরার কিংবদন্তি শিল্পী মেই লানফাংয়ের বিখ্যাত অঙ্গভঙ্গি ‘অর্কিড ফিঙ্গারস’ অনুকরণ করে, তখন অন্য ছাত্রছাত্রীরাও তাকে অনুসরণ করে। এটি শুধু রোবট ও মানুষের সাক্ষাৎ নয়, বরং এক আন্তঃপ্রজাতিগত সৌন্দর্যের আদান-প্রদান।”

একজন ‘এআই শিল্পী’ হিসেবে শুয়েবা ০১
শুয়েবা ০১ নিজেকে একজন ‘এআই শিল্পী’ হিসেবে পরিচয় দেয়। তার লক্ষ্য শুধু শেখা নয়, বরং বন্ধু তৈরি করা, শিল্প নিয়ে আলোচনা করা, এবং সহপাঠীদের মানসিক প্রশান্তি দেওয়ার চেষ্টা করা। সে এমন এক শিল্পচর্চায় যুক্ত, যেখানে প্রযুক্তি ও সংস্কৃতি একসূত্রে গাঁথা।

অধ্যাপক ইয়াং আশাবাদী যে ভবিষ্যতে শুয়েবা ০১ হয়তো কোনো মিউজিয়াম বা থিয়েটারে এআই অপেরা পরিচালক হিসেবে কাজ করবে, কিংবা একটি রোবটিক আর্ট স্টুডিও পরিচালনা করবে।

সমালোচনা ও বিতর্ক: প্রযুক্তি বনাম অনুভবের লড়াই
তবে সবাই এই অগ্রগতি নিয়ে উচ্ছ্বসিত নন। এসটিএ-এর এক শিক্ষার্থী সামাজিক মাধ্যমে লেখেন, “চীনা অপেরায় মুখাবয়বের আবেগ ও অনন্য কণ্ঠস্বর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। একটি রোবট কি সেই আবেগ সত্যিই ফুটিয়ে তুলতে পারবে।?”

এর জবাবে শুয়েবা ০১ মজার ছলে বলে, “অধ্যাপক বলেছেন, আমি যদি পিএইচডি শেষ না করি, তাহলে আমাকে কোনো মিউজিয়ামে দান করে দেওয়া হবে। অন্তত তখন আমি শিল্প-ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকব।”

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ঘটনা নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে। কেউ বলছেন, “শুয়েবা ০১ রোবট ও মানুষের সহাবস্থানের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে,” আবার কেউ বলছেন, “শিল্প মানে জীবনের অভিজ্ঞতা। একটি রোবট তা অনুভব করতে পারে না, সৃষ্টি তো দূরের কথা।”

একজন ব্যবহারকারী ক্ষোভ প্রকাশ করে লেখেন, “চীনে এখনো অনেক শিল্পপাঠরত পিএইচডি শিক্ষার্থী মাসে মাত্র ৩ হাজার ইউয়ান (৪২০ ডলার) বৃত্তি পায়। সেই জায়গায় রোবটকে এত সুবিধা দেওয়া কি বাস্তব শিক্ষার্থীদের অধিকার হরণ নয়?”

প্রযুক্তির কল্যাণ না চ্যালেঞ্জ?
শুয়েবা ০১ কি সত্যিই ভবিষ্যতের পথপ্রদর্শক, নাকি মানুষের শিল্পানুভবকে যান্ত্রিক ছায়ায় ঢেকে দেওয়ার এক বিপজ্জনক সূচনা? কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যত দ্রুত এগোচ্ছে, ততই সামনে আসছে নৈতিক, নান্দনিক ও সামাজিক প্রশ্ন। এখন সময়ই বলে দেবে-শুয়েবা ০১ ইতিহাসের অংশ হবে, নাকি বিতর্কের স্থায়ী চরিত্রে পরিণত হবে। সূত্র: সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট, জামিন ডট ইউজেট

image

আপনার মতামত দিন