‘দেজা ভু’ এক অদ্ভূত অনূভূতি। এর ফলে অচেনা কোনো বিষয়কে চেনা মনে হয়। ভ্রমণেও হতে পারে এটা। তাই ছুটির দিনে ঢাকার কাছে এই ৫টি জায়গা ঘুরে আপনি পেতে পারেন ‘দেজা ভু’ অভিজ্ঞতা।
সাদার্ন মেথোডিস্ট ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞানী অ্যালান এস ব্রাউন ২০০৩ সালে একটি গবেষণা করে দেখেন, ৬০ শতাংশ মানুষের জীবনে একবার হলেও ‘দেজা ভু’-জাতীয় অভিজ্ঞতা রয়েছে। ‘দেজা ভু’র মতো ঘটনা কি কখনো ঘটেছে আপনার সঙ্গে? যে অনুভূতির কারণে জীবনে প্রথম দেখা অচেনা জায়গাকেও চেনা মনে হয়, মনে হয় এ জায়গায় আপনি যেন আগেও এসেছেন। বিশেষজ্ঞরা বলেন, সাধারণত কোনো জায়গায় বেড়াতে গেলে অনেকেই দেজা ভুর মতো অনুভূতির সম্মুখীন হন।
দেজা ভু গবেষক ক্রিস মৌলিনের মতে, আমরা যখন একেবারে নতুন কোনো জায়গা বা অভিনব কোনো অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হই, তখনই এই অনুভূতি সবচেয়ে প্রবল হয়। তাঁর মতে, একেবারে অপরিচিত জায়গায় গিয়ে যখন আমাদের জায়গাটা চেনা বলে মনে হতে থাকে, আমাদের অবাক করে যে সেখানে আমরা আগে কখনো যাইনি, তখন এই দুইয়ের মধ্যে একটা বিরাট দ্বন্দ্ব তৈরি হয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষ যত বেশি ভ্রমণ করে, তত বেশি দেজা ভুর অনুভূতি হয়। দেজা ভু নিয়ে এত কথার কারণ হচ্ছে, পুরোনো কোনো বাড়ি, বিশেষ করে শত বছরের পুরোনো পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন কিংবা জমিদারবাড়িতে গেলে আমি দেজা ভুর মুখোমুখি হই। ছুটির দিনে কিংবা সপ্তাহের শেষে ও অবসর সময়ে সারা দিনের সময় হাতে রেখে এমন কিছু প্রাচীন স্থাপত্যের সান্নিধ্যে সময় কাটিয়ে আসতে পারেন। আমার মতো করে আপনারও দেজা ভু হয় কি না, যাচাই করে দেখতে পারেন।
পানাম নগর
পানাম নগর নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁয় অবস্থিত। বড় নগর, খাস নগর, পানাম নগর-প্রাচীন সোনারগাঁর এই তিন নগরের মধ্যে পানাম ছিল সবচেয়ে সুন্দর। এখানে কয়েক শতাব্দী পুরোনো অনেক ভবন রয়েছে, যা বাংলার বারো ভূঁইয়াদের ইতিহাসের সঙ্গে সম্পর্কিত। সোনারগাঁর ১০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে এই নগরী গড়ে ওঠে। এক হাজার বছরের পুরোনো প্রাচীন এই শহর হারানো নগরী হিসেবে পরিচিত। রাস্তার দুই পাশে সুলতানি, মোগল আর পরে ব্রিটিশ সভ্যতার স্থাপত্য নিদর্শনসমৃদ্ধ প্রাচীন ও ভগ্নপ্রায় বিভিন্ন স্থাপনা রয়েছে এখানে। প্রশাসনিক প্রয়োজন ও ব্যবসা-বাণিজ্যের কারণে বিদেশি বণিকেরা এখানে এসে বসবাস করতেন। পানাম নগরে ৫২টি পুরোনো ভবন রয়েছে। অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে নির্মিত পানাম নগরীর প্রতিটি ভবনের সূক্ষ্ম কারুকাজে স্থানীয় কারিগরদের শিল্পদক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়। এখানে যেকোনো সময় প্রবেশ করা যায়। প্রবেশ ফি জনপ্রতি ১৫ টাকা।
বালিয়াটি জমিদারবাড়ি
বালিয়াটি জমিদার বাড়ি ঢাকা বিভাগের মানিকগঞ্জ জেলা সদর থেকে আনুমানিক ৮ কিলোমিটার পশ্চিমে এবং ঢাকা জেলা সদর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে সাটুরিয়া উপজেলার বালিয়াটি গ্রামে অবস্থিত। বালিয়াটি জমিদারবাড়ি উনিশ শতকের স্থাপত্যকৌশলের একটি অন্যতম নিদর্শন। প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো জমিদারবাড়িটি ইতিহাস-ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এ বাড়িতে গেলে আপনি তৎকালীন সময়ের মানুষের জীবন-জীবিকা, চালচলন, আনন্দ-বিনোদন আর শৌখিনতার পরিচয় দেখতে পাবেন। স্থানীয় ইতিহাস থেকে পাওয়া যায়, গোবিন্দরাম সাহা বালিয়াটি জমিদার পরিবারের গোড়াপত্তন করেন। তিনি লবণের ব্যবসায়ী ছিলেন। আঠারো শতকের প্রথম ভাগ থেকে ২০০ বছরের বেশি সময় ধরে বালিয়াটির জমিদারেরা ওই এলাকা শাসন করেন। এ সময়ে তাঁরা নানা রকম গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা তৈরি করেন।
বালিয়াটি জমিদারবাড়ি সেগুলোর অন্যতম। আঠারো শতকের মধ্যভাগে জমিদার গোবিন্দরাম সাহা বালিয়াটি জমিদারবাড়ি নির্মাণ করেন। ক্রমান্বয়ে তাঁর উত্তরাধিকারীরা এখানে নির্মাণ করেন আরও বেশ কিছু স্থাপনা। গ্রীষ্মকালীন খোলার সময় সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত। শীতকালীন খোলার সময় সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। জমিদার বাড়িতে প্রবেশের জন্য টিকিটের মূল্য জনপ্রতি বাংলাদেশি দর্শনার্থীদের জন্য ২০ টাকা, সার্কভুক্ত দর্শনার্থী ১০০ টাকা এবং বিদেশি দর্শনার্থী ২০০ টাকা।
জিনজিরা প্রাসাদ
ইতিহাসের সাক্ষী জিনজিরা প্রাসাদ এক ঐতিহাসিক পুরাকীর্তি, যা ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীর ওপারে কয়েক শ গজ দূরে অবস্থিত। সিরাজদ্দৌলার স্ত্রী লুৎফুন্নেসা ও তাঁর শিশুকন্যাকে মীরজাফরের পুত্র মীরনের নির্দেশে এখানে বন্দী করে রাখা হয়েছিল। এ প্রাসাদের নির্মাণশৈলী বড় কাটরার আদলে হলেও কক্ষ ও আয়তন অনেক কম। পশ্চিমাংশে দুটি সমান্তরাল গম্বুজ, মাঝবরাবর ঢাকনাবিহীন অন্য একটি গম্বুজ ও পূর্বাংশ দোচালা কুঁড়েঘরের আদলে পুরো প্রাসাদের ছাদ। প্রাসাদের পূর্বাংশে ছাদ থেকে একটি সিঁড়ি নিচে নেমে গেছে। স্থানীয় লোকজন এ প্রাসাদকে হাবেলি নগেরা বা হাওলি নগেরা বলে। এ প্রাসাদের তিনটি বিশেষ অংশ এখন টিকে আছে-প্রবেশতোরণ, পৃথক দুটি স্থানে দুটি পৃথক প্রাসাদ, একটি ফাঁসির মঞ্চ, অন্যটি প্রমোদাগার।
কয়েক একর জমির ওপর এ প্রাসাদ নির্মাণ করা হয়েছিল অবকাশযাপন ও চিত্তবিনোদনের জন্য। চারদিকে সুনীল জলরাশির মাঝখানে একখণ্ড দ্বীপভূমি জিনজিরা। স্থানীয়দের মতে, মোগল আমলে লালবাগ দুর্গের সঙ্গে জিনজিরা প্রাসাদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষার জন্য বুড়িগঙ্গার তলদেশ দিয়ে একটি সুড়ঙ্গপথ তৈরি করা হয়েছিল। প্রখ্যাত ব্রিটিশ লেখক জেমস টেইলর তাঁর ‘টপোগ্রাফি অব ঢাকা’ বইয়ে নবাব ইব্রাহিম খাঁকে জিনজিরা প্রাসাদের নির্মাতা বলে উল্লেখ করেছেন। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. মুনতাসির মামুন বলেন, জিনজিরা প্রাসাদের সঙ্গে অষ্টাদশ শতাব্দীর বাংলার ইতিহাসের এক বিষাদময় স্মৃতিজড়িত। ইতিহাসের সাক্ষী এই স্থানে গেলে দেজা ভুর মতো অনুভূতি হয়েও যেতে পারে।
বিরুলিয়া জমিদারবাড়ি
ঢাকার কাছের তুরাগ নদীর তীরে অবস্থিত বিরুলিয়া গ্রাম। জমিদার রজনীকান্তের বাড়িসহ কয়েকটি বিখ্যাত প্রাচীন স্থাপনার জন্য গ্রামটি বেশ পরিচিত। গ্রামে ঢুকতেই চোখে পড়বে জমিদার রজনীকান্তের জমিদারবাড়ি। জরাজীর্ণ বাড়ির বিভিন্ন জায়গা থেকে খসে পড়েছে পলেস্তারা। বের হয়ে এসেছে ইটসুরকি। প্রায় শত বছর বয়সী বাড়িটি কালের সাক্ষী হয়ে এখনো দাঁড়িয়ে আছে জীর্ণশীর্ণ অবয়ব। জমিদারবাড়ি-সংলগ্ন ভবন ছিল ১৪-১৫টি। কালের পরিক্রমায় এখন টিকে আছে ৭-৮টি। তবে সব কটি দৃষ্টিনন্দন। প্রাচীন নানা ধরনের স্থাপনায় সমৃদ্ধ বিরুলিয়া গ্রাম এখনো মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য ও আভিজাত্য বহন করে চলছে। এখনো কালের সাক্ষী হিসেবে গ্রামের শেষ মাথায় রয়েছে শতবর্ষী একটি বিখ্যাত বটগাছ।
শ্রীফলতলী জমিদারবাড়ি
গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলায় অবস্থিত দুটি প্রাচীনতম জমিদারবাড়ির মধ্যে একটি হচ্ছে শ্রীফলতলী জমিদারবাড়ি। বাংলাদেশের অন্যতম প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনাগুলোর মধ্যে অন্যতম ধরা হয় এ বাড়িকে। এই জমিদারবাড়ির রয়েছে দুটি অংশ-একাংশ হলো বড় তরফ, অপর অংশ ছোট তরফ। বিখ্যাত তালিবাবাদ পরগনার ৯ আনা অংশের মালিকানা নিয়ে গঠিত হয় শ্রীফলতলী জমিদার এস্টেট। এই এস্টেটের প্রধান কর্ণধার খোদা নেওয়াজ খানের কনিষ্ঠ পুত্র রহিম নেওয়াজ খান চৌধুরীর হাত ধরে এই শ্রীফলতলী জমিদারবাড়ির গোড়াপত্তন ঘটে। জমিদারি পরিচালনায় তিনি তাঁর নিজের কাছারিবাড়ির পাশাপাশি আধারিয়া বাড়ির বাগানবাড়িকে অফিস হিসেবে ব্যবহার করতেন। তাঁর জমিদারির পরিসীমা ময়মনসিংহ, নরসিংদি ও সাটুরিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। তাঁর প্রচেষ্টাতেই আজ থেকে প্রায় ১০০ বছর আগে তালিবাবাদ পরগনা সাভার থেকে পৃথক হয়ে ‘কালিয়াকৈর’ নামে নতুন থানা হিসেবে পরিচিতি পায়।
বড় তরফে আপনি অনুমতি ছাড়াই প্রবেশ ও ঘুরে দেখতে পারবেন। ছোট তরফে জমিদারের উত্তরাধিকারীরা এখনো বাস করেন এবং শুটিং স্পট হিসেবেও ভাড়া দেন। তবে সেখানে প্রবেশ করা যাবে অনুমতি সাপেক্ষে। বড় তরফ ও ছোট তরফের মধ্যে জমিদারবাড়ির মসজিদ, যা সময়ের চাহিদায় বর্ধিত করা হয়েছে। প্রবেশ করলে বড় তরফের ডান পাশে আরেকটি ছোট তরফ চোখে পড়বে। বাইরে থেকে ঘুরে দেখতে পারবেন, জমিদারবাড়ির সব দরজাই তালাবদ্ধ। বড় তরফের পেছনের অংশে কিছু পরিবার বাস করে। সূত্র: হাল ফ্যাশন
লেখা: নাদিয়া ইসলাম