বিশ্বজুড়ে ইন্টারনেট সংযোগের নতুন বিপ্লব আনছে স্যাটেলাইট-ভিত্তিক প্রযুক্তি। বিশেষ করে দুর্গম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে এই প্রযুক্তির গুরুত্ব দিন দিন বেড়েই চলেছে। ভারতও বাদ যাচ্ছে না এই দৌড়ে। সম্প্রতি ইলন মাস্কের স্টারলিংক এবং মুকেশ আম্বানির জিও-সহ একাধিক প্রতিষ্ঠানকে স্যাটেলাইট ইন্টারনেট চালুর জন্য লাইসেন্স দিয়েছে ভারত সরকার। তবে এই অনুমোদনের পদ্ধতি এবং স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন অনেকে।
লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে-কিন্তু কীভাবে?
ভারতের ইন-স্পেস (Indian National Space Promotion and Authorization Center)-এর চেয়ারম্যান পবন গোয়েঙ্কা জানিয়েছেন, স্টারলিংকের লাইসেন্স সংক্রান্ত প্রায় সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। যদিও এ সেবা আনুষ্ঠানিকভাবে এখনও চালু হয়নি, দেশটির বৃহৎ ভূখণ্ড বিশেষ করে দুর্গম এলাকা ও সীমান্তে এই প্রযুক্তি বড় পরিবর্তন আনতে পারে বলেই আশা করা হচ্ছে।
তবে বিতর্ক শুরু হয়েছে লাইসেন্স দেওয়ার পদ্ধতি নিয়ে। মোদি সরকার নিলাম ছাড়াই, শুধুমাত্র প্রশাসনিক আদেশের মাধ্যমে স্পেকট্রাম বরাদ্দ করেছে। প্রশ্ন উঠেছে-সরকার যদি এমন গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ সরাসরি নির্দিষ্ট বেসরকারি সংস্থাকে দিয়ে দেয়, তাহলে স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতা কোথায়?
স্পষ্ট নয় শর্তাবলি, তৈরি হচ্ছে একচেটিয়াবাদ?
স্টারলিংক, জিও ও এয়ারটেলের মতো বড় কোম্পানিকে দেওয়া লাইসেন্সের শর্তাবলি এখনও প্রকাশ্যে আসেনি। বিশ্লেষকদের দাবি, এতে কারও প্রতি পক্ষপাত বা সংস্থান হস্তান্তরে বৈষম্যের আশঙ্কা থেকে যায়। এমনকি সরকারের বিরুদ্ধে স্টারলিংক-জিও-এয়ারটেল মিলে ‘কার্টেল’ গঠনেরও অভিযোগ উঠেছে-যার মাধ্যমে তারা একচেটিয়াভাবে স্যাটেলাইট ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
২জি মামলার রায় কি উপেক্ষিত?
ভারতের সাবেক প্রশাসনিক সচিব ই. এ. এস শর্মা মনে করছেন, সরকারের এই সিদ্ধান্ত সুপ্রিম কোর্টের ২জি স্পেকট্রাম মামলার রায় লঙ্ঘন করে। ওই ঐতিহাসিক রায়ে বলা হয়েছিল-জাতীয় সম্পদ বরাদ্দে স্বচ্ছ, প্রকাশ্য ও প্রতিযোগিতামূলক পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। এই অভিযোগের প্রেক্ষিতে শর্মা একটি বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানিয়েছেন।
জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে স্টারলিংক কি ঝুঁকি?
শুধু আর্থিক নয়, জাতীয় নিরাপত্তা নিয়েও উদ্বেগ আছে। শর্মা উল্লেখ করেন, স্টারলিংকের সঙ্গে মার্কিন সেনাবাহিনীর সম্পর্ক রয়েছে, ফলে এই সংযোগের মাধ্যমে ভারতীয় ভূখণ্ডে নজরদারি বা সামরিক হস্তক্ষেপের ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।
এর বাস্তব নজির পাওয়া গেছে মণিপুরের সাম্প্রতিক সংঘর্ষে, যেখানে অভিযোগ উঠেছে যে বিদ্রোহী গোষ্ঠী PLA (People’s Liberation Army) স্টারলিংক ব্যবহার করে ইন্টারনেট চালু রেখেছে-যদিও ভারতে স্টারলিংক এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয়নি। প্রতিবেশী মিয়ানমারে এটি বৈধভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, সেখান থেকেই ডিভাইস এনে সীমান্ত এলাকায় সক্রিয় করা হচ্ছে।
আরটিআই (তথ্য জানার অধিকার)-এর মুখেও তালা?
কমনওয়েলথ হিউম্যান রাইটস ইনিশিয়েটিভ (CHRI)-এর পরিচালক বেঙ্কটেশ নায়ক আরটিআই আইনে সরকারের কাছে জানতে চান-কে লাইসেন্স পেয়েছে, কী শর্তে পেয়েছে, আবেদনকারীদের তালিকাই বা কী? সরকার শুধু প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম জানায়, বাকি তথ্যকে গোপনীয় বলে ফেলে আরটিআই আইনের ৮(১)(ডি) ও ৮(১)(ই) ধারায়।
কিন্তু আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, এই যুক্তি টেকসই নয়। কারণ সরকার ফিডিউশিয়ারি নয়, নিজের সাংবিধানিক দায়িত্বে এই তথ্য সংগ্রহ করেছে, যা প্রকাশ করা বাধ্যতামূলক। এমনকি সুপ্রিম কোর্টও বলেছে, "জনস্বার্থে সংগৃহীত তথ্য ব্যক্তিগত বলে গোপন রাখা যায় না।"
প্রযুক্তি হোক স্বচ্ছতার পথে, অন্ধকারে নয়
সত্যি কথা বলতে কি, ভারত স্যাটেলাইট ইন্টারনেটের যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে, এটা নিঃসন্দেহে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে এই যাত্রার পথ কতটা স্বচ্ছ, ন্যায্য ও নিরাপদ?
সরকার যখন গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সম্পদ (যেমন: স্পেকট্রাম) বেসরকারি কোম্পানির হাতে তুলে দেয়, তখন সে সিদ্ধান্তে থাকা উচিত জনগণের জানার অধিকার, আইনগত ভিত্তি এবং জাতীয় নিরাপত্তার পূর্ণ বিবেচনা। নয়তো আধুনিক প্রযুক্তির ছদ্মবেশে নির্বাচনী রাজনীতি, আর্থিক লেনদেন ও বৈশ্বিক শক্তির প্রভাব চালানোর অভিযোগ অস্বীকার করা কঠিন হয়ে পড়ে। সূত্র: দ্য ওয়্যার, টেলিগ্রাফ ইন্ডিয়া