২০২৪ সাল প্রযুক্তি আর বিজ্ঞানের জগতে সত্যি অসাধারণ ছিল! এমন সব চমকপ্রদ আবিষ্কার হয়েছে যা দেখে বিশ্ববাসী মুগ্ধ। টাইম ম্যাগাজিন ২০২৪ সালের সেরা কিছু উদ্ভাবনের তালিকা প্রকাশ করেছে। এই প্রতিবেদনে সারা বছরের আলোচিত কিছু উদ্ভাবন সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে আবহাওয়ার পূর্বাভাস
২০২৪ সালে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার বৈপ্লবিক উন্নয়ন ঘটিয়েছে। অ্যাটমো নামের একটি স্টার্টআপ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়ার এক অসাধারণ মডেল তৈরি করেছে। ভাবুন, ৬০ বছরের জলবায়ুর তথ্য বিশ্লেষণ করে এমন নিখুঁত পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব!
এআই দিয়ে এটা ৪০ হাজার গুণ দ্রুত আর ১০০ গুণ বেশি বিস্তারিত তথ্য দিতে পারে। প্রচলিত মডেলের তুলনায় ৫০% বেশি নির্ভুল এই টুলটি সারা পৃথিবীর ১৪২টি স্যাটেলাইট আর লাখ লাখ সেন্সরের তথ্য ব্যবহার করে। টুভালু দ্বীপ আর মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগ এরই মধ্যে এই টুলটি ব্যবহার শুরু করেছে।
ঘরে বসেই মেডিকেল চেকআপ করার টুল উদ্ভাবন
২০২৪ সালে প্রযুক্তির ক্ষেত্রে আরেকটি উল্লেখযোগ্য উদ্ভাবন হলো ‘উইদিংস বিমও’। টিভির রিমোটের মতো দেখতে এই ডিভাইসটি একইসঙ্গে চারটি মেডিকেল চেকআপ পরিচালনা করতে সক্ষম। এতে ব্যবহৃত অত্যাধুনিক সেন্সরের মাধ্যমে শরীরের তাপমাত্রা নির্ধারণ, ফুসফুসের অবস্থা পর্যবেক্ষণ, হার্ট স্ক্যান এবং রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা পরীক্ষা করা যায়।
বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, এই ডিভাইস ঘরোয়া স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটাবে। এর মাধ্যমে সংগ্রহ করা ডেটা একটি অ্যাপে সংরক্ষিত হয়, যা চিকিৎসকের কাছে পাঠিয়ে রোগ নির্ণয়ের কাজ আরও সহজ করা যায়। একটি ডিভাইস দিয়ে পরিবারের আটজন সদস্যের স্বাস্থ্য তথ্য সংরক্ষণ সম্ভব, যা এটিকে আরও কার্যকর করে তুলেছে। বিশ্বজুড়ে এরই মধ্যে দেড় কোটি ব্যবহারকারী এই ডিভাইস ব্যবহার করছেন। সহজলভ্যতার জন্য ডিভাইসটি ফার্মেসি থেকে সরাসরি কেনা যাবে।
কৃত্রিম হৃদ্যন্ত্র উদ্ভাবন
২০২৪ সালে কৃত্রিম হৃদ্যন্ত্র উদ্ভাবনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটেছে। অস্ট্রেলিয়ান বায়োমেডিকেল প্রকৌশলী ড্যানিয়েল টিমস এবং তাঁর প্রতিষ্ঠান বাইভ্যাকর একটি কৃত্রিম হৃৎপিণ্ড তৈরি করেছেন, যা আসল হৃদ্যন্ত্রের মতো সারা শরীরে রক্ত পরিবহন করতে সক্ষম।
এ বছরের জুলাই মাসে টেক্সাসে প্রথমবারের মতো টাইটেনিয়ামের তৈরি বাইভেন্ট্রিকুলার রোটারি ব্লাড পাম্প সফলভাবে মানবদেহে স্থাপন করা হয়। এ উদ্ভাবন চিকিৎসাবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ২০২৪ সালে তিনজন মার্কিন রোগীর শরীরে এই কৃত্রিম হৃদ্যন্ত্র স্থাপন করা হয়েছে।
অগমেন্টেড রিয়েলিটি প্রযুক্তির মাধ্যমে অপারেশন থিয়েটার ব্যবস্থাপনা
অস্ত্রোপচার কক্ষের কার্যক্রম অনেক জটিল ও বিশৃঙ্খল হতে পারে। একেকজন চিকিৎসকের পছন্দ ও প্রয়োজন অনুযায়ী যন্ত্রপাতি ব্যবস্থাপনা করা সবসময় সহজ হয় না। অপারেশন থিয়েটারে ব্যবস্থাপনার এই জটিলতা কমানোর জন্য প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান এক্সইএক্স তাদের এক্সপেরিয়েন্সএক্স নামক অগমেন্টেড রিয়েলিটি প্রযুক্তি চালু করেছে।
এই প্রযুক্তি অপারেশন থিয়েটারের একটি ভার্চ্যুয়াল মানচিত্র তৈরি করতে সক্ষম, যা চিকিৎসকদের পছন্দ অনুযায়ী যন্ত্রের সঠিক অবস্থান জানায়। এটি চিকিৎসক ও অপারেশনে সহযোগীদের মধ্যে সমন্বয় বাড়ায় এবং সময়মতো অস্ত্রোপচার নিশ্চিত করে। বর্তমানে যুক্তরাজ্যের লন্ডনের ক্রমওয়েল হাসপাতালে এই প্রযুক্তির পাইলটিং চলছে, যা স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনা উন্মোচন করেছে।
গবেষণাগারে তৈরি তন্তু
২০২৪ সালে প্রাকৃতিক তন্তুর বিকল্প হিসেবে গবেষণাগারে কৃত্রিম তন্তু তৈরির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটেছে। গ্যালি কো নামের একটি প্রতিষ্ঠান "লিটারেলি কটন" নামের কৃত্রিম তুলা উদ্ভাবন করেছে। এই উদ্ভাবন প্রাকৃতিক সেলুলার তন্তুর ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনতে সহায়ক হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
প্রচলিত পদ্ধতিতে তুলা সংগ্রহের জন্য বন উজাড় এবং প্রচুর পানি ও রাসায়নিক ব্যবহারের প্রয়োজন হয়। গ্যালি ল্যাব এই জটিলতাগুলো এড়িয়ে বিশেষায়িত কোষের মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব উপায়ে তুলা তৈরি করছে, যা চাষকৃত তুলার মতোই গুণমানসম্পন্ন।
এই উদ্ভাবন বিশ্ব ফ্যাশন শিল্পেও প্রভাব ফেলেছে। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে ফ্যাশন ব্র্যান্ড জারার মূল প্রতিষ্ঠান ইন্ডিটেক্স গ্যালি কো-র একটি উল্লেখযোগ্য অংশ কিনে নিয়েছে, যা কৃত্রিম তন্তুর বাণিজ্যিক সম্ভাবনাকে আরও দৃঢ় করেছে।
সবচেয়ে বড় চিপ
২০২৪ সালে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই প্রযুক্তি চালানোর জন্য সেমিকন্ডাক্টর শিল্পে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখা গেছে। সেরেব্রাস সিস্টেম এই বছর মার্চে তাদের তৃতীয় প্রজন্মের চিপ ‘‘ওয়েফার-স্কেল ইঞ্জিন ৩’’ প্রকাশ করেছে, যা বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় চিপ হিসেবে পরিচিত।
এই চিপটি ওপেনএআইয়ের জিপিটি-৪ মডেলের চেয়ে ১০ গুণ বড় মডেলকে প্রশিক্ষণ দিতে সক্ষম। "ওয়েফার-স্কেল ইঞ্জিন ৩" চিপটি কনডোর গ্যালাক্স ৩ নামে একটি সুপারকম্পিউটারে ব্যবহার করা হবে, যা চিপের শক্তিশালী কার্যক্ষমতা আরও বৃদ্ধি করবে।
ম্যালেরিয়ার টিকা
২০২৪ সালে, কয়েক দশকের গবেষণার পর, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ম্যালেরিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য দুটি নতুন টিকার সুপারিশ করেছে। ম্যালেরিয়া প্রতিবছর লাখ লাখ মানুষকে সংক্রমিত করে এবং প্রায় ছয় লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটায়। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং সিরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া মিলে আর২১/ম্যাটিক্স-এম নামক একটি টিকা তৈরি করেছে, যা ম্যালেরিয়া অ্যান্টিজেন আর২১-কে লক্ষ্য করে কাজ করে।
এই টিকাটির সঙ্গে নোভাভ্যাক্সের তৈরি একটি টিকা যোগ করা হয়েছে, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করে। সিরাম ইনস্টিটিউট মে মাসে প্রথম ম্যালেরিয়া টিকার ডোজ বাজারে আনে এবং প্রতি ডোজের দাম প্রায় ৪ ডলার। প্রস্তুতকারকরা আফ্রিকায় প্রতি বছর ৫০ থেকে ৬০ মিলিয়ন ডোজ ম্যালেরিয়া টিকা সরবরাহের জন্য কাজ করছে।
দীর্ঘমেয়াদি ব্যাটারি তৈরি
২০২৪ সালে আলোচিত উদ্ভাবনের মধ্যে অন্যতম হলো দীর্ঘমেয়াদী ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত করা যান্ত্রিক ব্যাটারি। টোরাস নোভা স্পিন নামের একটি প্রতিষ্ঠান এই ব্যাটারিটি তৈরি করেছে, যা ২৫ বছর মেয়াদে কার্যকর থাকবে। ব্যাটারিটি প্রায় ৯৫ শতাংশ পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপকরণ থেকে তৈরি করা হয়েছে।
সাধারণভাবে গ্রিড পাওয়ার বা সৌর প্যানেলে একটি ক্রমাগত ঘূর্ণায়মান রটার চালানো হয়, যা শক্তিকে গতিশক্তিতে রূপান্তরিত করে। মেকানিক্যাল ব্যাটারি এই গতিশক্তিকে পুনরায় বিদ্যুতে রূপান্তরিত করতে সক্ষম। প্রতি সিস্টেমের দাম ৮৫ হাজার মার্কিন ডলার, এবং এই ব্যাটারিগুলি রাসায়নিক ব্যাটারির চেয়ে তিন গুণ বেশি সময় ধরে কাজ করতে পারে। সূত্র: টাইম ম্যাগাজিন